চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সেলেকাওদের ‘দুঃখ-বিলাস’

চোখ ভরা স্বপ্ন দেখে আর দেখিয়ে শুরু। এরপর হাসি, আনন্দ আর স্বপ্নের পথ ধরে এগিয়ে চলা। হঠাৎ ছন্দপতন, হার, কান্না, অভিমান, বিদায়, অবসর। ১৯৭০’এ তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার পর থেকেই এমন সুখ-দুঃখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে নান্দনিক ফুটবলে বিশ্বাসী সেলেকাও ভক্তদের জীবন নৌকা।

’৭০-এর পরের দুই যুগ সেরা ফুটবলার, অমিত সম্ভাবনা নিয়েও ব্রাজিল বিশ্বকাপের ছোঁয়া পায়নি। কত হতাশা, বুকফাটা আর্তনাদ দীর্ঘশ্বাস আমাজনের জলে ভেসে গেছে। ’৯৪-এ চতুর্থবার কাপ জয়, ’৯৮-এ ফাইনালে খেলা, ২০০০ সালে পেন্টা জেতায় মনে হচ্ছিল ফুটবলের পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে এবার পা রেখে চলতে শিখেছে ‘জোগো-বোনিতো’।

ফিট থাকতে সবার আগে চিনি বাদ দিন, প্রাকৃতিক ও নিরাপদ জিরোক্যাল-এর মিষ্টি স্বাদ নিন।

কিন্তু ২০০২ সালের পরের দুই যুগে ফিরে এসেছে ১৯৭০-১৯৯৪ সালের বন্ধ্যাকাল। ২০০৬, ২০১০, ২০১৮, ২০২২ সালের আসরের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই ঝরে পড়া। ২০১৪ সালের আসরে নিজেদের মাঠ বেলো হরিজন্তে’তে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে নাকাল হওয়ার স্মৃতি এখনো ব্রাজিলকে ভাসিয়ে দেয় চোখের নোনা জলে।

এবারের আসরে ‘হেক্সা’ জেতার সেরা সুযোগ এসেছিল টিটে ও তার দলের সামনে। বলা হচ্ছিল সত্তর-আশির দশকের ‘সোনালী প্রজন্ম’ ফিরে এসেছে ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, রিচার্লিসন, অ্যান্টনি, রাফিনহার শিল্পিত পায়ে ভর করে। ফিফার নাম্বার ওয়ান, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে ‘হট ফেভারিট’ ব্রাজিলের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ায় বিস্মিত ফুটবল দুনিয়া। বিশেষ করে এক তারকা নির্ভর দল ক্রোয়েশিয়া যেভাবে সেলেকাওদের নিষ্ক্রিয় করে চোখের সামনে জয় নিয়ে গেল তাতে প্রশ্ন উঠে গেছে ইউরোপের অত্যাধুনিক ফুটবল দর্শন’কে টেক্কা দিয়ে ব্রাজিল আদৌ কি আর বিশ্বকাপ জিততে পারবে?

এরমধ্যেই ফুটবল দার্শনিক হিসাবে স্বীকৃত টিটে’র কৌশলের সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, টিটে’র ভুল কৌশলের মাশুল গুনলো ‘পেলে’র দেশ।’ আসলে কি বিদ্যমান বাস্তবতায় টিটে’র পক্ষে ব্রাজিলের খেলার স্টাইলের খোলনলচে বদলে দেয়া সম্ভব? সাফল্য বা ট্রফি নয়, ব্রাজিল ভক্তদের চিরদিনের চাওয়া একইসঙ্গে ট্রফি এবং ‘জোগো-বোনিতো’ বা সুন্দর চোখ জুড়ানো ফুটবল।

আরও পরিষ্কার করে বললে, ক্রমাগত আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে নাকাল করা দেখতে চায় সমর্থকরা। পৃথিবীতে ব্রাজিলীয়রাই একমাত্র দর্শক যারা জয়ের চেয়েও বেশী গুরুত্ব দেয় কত সুন্দরভাবে জয়টি এলো। আবার ভালো খেলতে গিয়ে হারাও যাবে না, তাহলে কান্না, মুণ্ডুপাত, সমালোচনা, প্রত্যাখ্যান। সেলেকাও কোচদের একইসঙ্গে ভাবতে হয় আক্রমণাত্মক চোখ জুড়ানো ফুটবলের পাশাপাশি ক্রমাগত সাফল্যে অর্জনের রেসিপি। এমন সোনার পাথর বাটি বাস্তবে সোনার হরিণের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য। ব্রাজিলের ফুটবল দর্শনে আক্রমণাত্মক ও শিল্পিত ফুটবলের কতটা কদর তা তাদের ফুটবল ইতিহাসের নন্দিত নায়কদের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।

পেলে, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রোনালদিনিয়ো, নেইমার পাতায় পাতায় সোনার আখরে লেখা সব আক্রমণে দক্ষ ফুটবল শিল্পীর নাম। রক্ষণের কেউ কিংবা গোলরক্ষক সেই রাজ্যে দুয়োরাণীর ছেলে! ডিফেন্ডাররা যে নায়কের তালিকায় নেই এমন নয়। জুনিয়র, জোসিমার, কাফু, রবার্তো কার্লোস, কার্লোস আলবার্টো পেরেইরা’র মতো তারকা ডিফেন্ডারদের পরিচয় আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক হিসাবে।

তারা রক্ষণে কতটা দক্ষ সেই বিচার কেউ করেনি, বরং তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে কতটা দক্ষতার সাথে তারা গোল করেছে, আক্রমণে সাহায্য করেছে। রবার্তো কার্লোসের নামের সাথে ভেসে ওঠে ফ্রি-কিকে করা তার অসাধারণ গোলটির কথা। ক’জন মনে রেখেছে ডিফেন্ডার রবার্তো কার্লোস’কে!

সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক ফুটবল দর্শনে ইউরোপ আনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, আনে শিল্পের মোকাবেলা। শরীর ও গতি নির্ভর রক্ষণাত্মক ফুটবল কৌশল। ‘গোল করি বা না করি, গোল খাওয়া যাবে না।’ রক্ষণ ও মাঝমাঠ মজবুত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে খেলতে না দেয়ার সেই কৌশলটি এখন ক্রমাগত রূপান্তর ও বিবর্তনে নাম নিয়েছে ‘প্রেসিং’ বা জোনাল প্রেসিং’এ। প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত চেপে ধরে তাদের বিচরণক্ষেত্র কমিয়ে ভুল করতে বাধ্য করা।

পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে প্রলুব্ধ করে নিজেদের সীমানায় টেনে এনে পাল্টা কাউন্টার অ্যাটাকে গোল আদায় করা, এটাই ইউরোপীয় দলগুলোর সাফল্যের মূল গোমর। এ সময়ের ফুটবল সম্পর্কে বলা হয়, ফরোয়ার্ড গোল করে ম্যাচ জেতায়, দলকে চ্যাম্পিয়ন করায় শক্তিশালী ডিফেন্স।’

কার্লোস দুঙ্গা

ইউরোপীয় দলগুলোর তুলনায় এক্ষেত্রেই ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে ব্রাজিল, উরুগুয়ের মতো ল্যাটিন দেশগুলো। বিষয়টি আমাদের মতো আমজনতা যেমন বোঝে, ব্রাজিলের ফুটবল পণ্ডিতরাও ভালো করেই বোঝে। তবে সেই কৌশল নিয়ে এগোতেই যত দ্বিধা। কার্লোস দুঙ্গা, ল্যাজারোনি ব্রাজিলের ফুটবলে রক্ষণে অতি নির্ভরতা আনতে গিয়ে ধিক্কৃত হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন।

সুন্দর ফুটবলের হত্যাকারী হিসাবে তাদের অপবাদ সইতে হয়েছে। সেলেকাওদের চিরাচরিত আক্রমণের সাথে রক্ষণ কৌশল নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন সোলারি, টিটেরা। তারা সাফল্য এনে খুব একটা প্রশংসা পাননি, কিন্তু যখনই ব্যর্থ হয়েছেন ব্রাজিলের ফুটবলের সৌন্দর্যহরণের জন্য চাকরি হারিয়েছেন। এজন্য কোনো কোচ ব্রাজিলের ফুটবল দর্শনে বিশাল কোনো পরিবর্তন আনার সাহস পান না। আবার বাস্তবতা হচ্ছে তাদের বর্তমান আধা-ল্যাটিন আধা-ইউরোপীয় কৌশল যে চূড়ান্ত সাফল্য দিচ্ছে না তা গত কয়েক আসরে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পারফরম্যান্সেই প্রমাণিত।

নক আউট রাউন্ড আর শক্ত রক্ষণাত্মক প্রতিপক্ষের কাছে বারবার আটকে যাচ্ছে সাম্বা ফুটবলের জাদু। কয়েক বছর ধরেই জাতীয় দলের জন্য ইউরোপীয় ঘরানার একজন কোচের সন্ধানে আছে ব্রাজিলীয় ফুটবল কনফেডারেশন। পেপ গার্দিওলা ও জাভি’কে ম্যানেজারের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দিয়েও সাড়া মেলেনি।

অন্যদিকে ইউরোপীয় রক্ষণ, হাই প্রেসিং’র সাথে ল্যাটিন সৃজনশীল আক্রমণের মিশেলে এক দারুণ স্ট্র্যাটেজি বের করে লিওনেল স্কালোনি আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক উচ্চতায়। টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থাকার পর সৌদি’র কাছে হার যে নিছকই দুর্ঘটনা তা প্রমাণ হয়েছে পরের টানা চার ম্যাচ জিতে। এই দলটি ভিন্ন এক আর্জেন্টিনা যাদের খেলায় ইউরোপীয় ঘরানার রক্ষণের সাথে মিশে আছে ল্যাটিন আমেরিকার শিল্পিত ফুটবলের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। ইউরোপের সেরা দলগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত প্রেসিং করে কঠিন পরিস্থিতিতে ম্যাচ জেতার সক্ষমতা রয়েছে দুই লিওনেল, মেসি ও স্কালোনির দলটির।

কোচিং দর্শন নিয়ে দ্বিধা বিভ্রান্তির পাশাপাশি আরও একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্বপ্নকে বারবার বিবর্ণ করছে। গোলের খেলা ফুটবলে যেকোনো ফর্মেশনেই একজন নিখাদ গোলবুভুক্ষু স্ট্রাইকারের প্রয়োজন সবসময়ের। পেলে’র মতো দক্ষ স্কোরার ব্রাজিল’কে জিতিয়েছেন তিন’তিনটি বিশ্বকাপ।

রোনাল্ডো, মিরোস্লাভ ক্লোসা, জেরার্ড মুলার কিংবা পাওলো রসি’র মতো ইতিহাস সেরা ‘নাম্বার নাইন’ ব্রাজিল, জার্মানি ও ইটালিকে জিতিয়েছেন একাধিক বিশ্বকাপ। ১৯৯৪ ও ২০০২’এ ব্রাজিলের শেষ দুই বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন রোমারিও এবং রোনাল্ডো নাজারিও। এ সময়ে ফুটবলে ফর্মেশন যত রক্ষণাত্মক হয়েছে, ‘নাম্বার নাইনের’ অপরিহার্যতা তত বেড়েছে।

বল পজেশন, পাসিং অ্যাকুরিসি’ এমনকি ‘শট অন টার্গেটে’র’ পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থেকেও যেকোনো দল খেলার ধারার বিরুদ্ধে জিততে পারে বেনজেমা, লেভান্ডোভস্কি, আর্লিং হালান্ডের মতো স্ট্রাইকার দলে থাকলে। ২০০২’র পর থেকে এমনই একজন দক্ষ গোলস্কোরারের অভাবে ভুগছে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কোয়াড।

দেশের হয়ে সর্বাধিক গোলের রেকর্ড গড়লেও মাঠে নেইমারের ভূমিকা প্লে-মেকারের। প্রতিভাবান হয়েও এবারের আসরে সেলেকাওদের স্কোরারের দুর্বলতা ঘোচাতে পারেননি রির্চালিসন কিংবা ভিনিসিয়ুস। একজন রোনাল্ডো নাজারিও, রোমারিও’র অভাব বড্ড অনুভব করেছে হেক্সার স্বপ্নে বিভোর ব্রাজিল।