ভারতকে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। ‘তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) ব্যাপারে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাটির।
ফিফার নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঘটনা অবশ্য অনেক দেশেরই আছে। অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে সেসব দেশ ফুটবলে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। পাঠকদের জন্য সেই দেশগুলোর কথা তুলে ধরা হল।
ইরাক (২০০৮ ও ২০০৯ সাল)
জাতীয় অলিম্পিক কমিটি এবং জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ভেঙে দিয়েছিল ইরাকি সরকার। ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইরাকের ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচের আগেই ২০০৮ সালে ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
ইরাক সরকার জানিয়েছিল, জাতীয় অলিম্পিক কমিটি এবং জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে প্রভাবিত করবে না। ফিফা বাগদাদ থেকে ইরাকি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে বিলুপ্তির জন্য জারি করা ডিক্রি প্রত্যাহারের বিষয়ে একটি চিঠি পায়। এর কয়েকদিন পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল।
ওই সময় ইরাকি ফুটবলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে ফিফা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিল, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তটি শর্তসাপেক্ষ এবং অস্থায়ী।
২০০৯ সালে ইরাক আবারও অলিম্পিক কমিটি ও দেশের ফুটবল ফেডারেশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের ফলে ফিফা মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ফের নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
নিষেধাজ্ঞার মাঝেও মেয়েদের ফুটবলের অগ্রগতির স্বার্থে জর্ডানে এক সপ্তাহব্যাপী ফুটবল উৎসবে নারী খেলোয়াড়দের অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
ইরাকি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের যেসব সদস্যদের বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাদের পুনর্বহালের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের মার্চে ইরাকের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ফিফা।
নাইজেরিয়া (২০১৪ সাল)
ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের জন্য নাইজেরিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (এনএফএফ) কার্যনির্বাহী কমিটিকে বরখাস্ত করা হয়। নাইজেরিয়ার একটি আদালত একজন বেসামরিক কর্মচারীকে ফেডারেশন পরিচালনার নির্দেশ দেয়।
এনএফএফের এমন হস্তক্ষেপে নাইজেরিয়াকে ফিফা নিষিদ্ধ করে। আদালতের আদেশ প্রত্যাহার হওয়ায় ৯ দিন পরই ফিফার সদস্যপদ ফিরে পায় দেশটি।
কুয়েত (২০১৫ সাল)
ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাজে কুয়েতের সরকার হস্তক্ষেপ করায় দেশটিকে আঞ্চলিক, মহাদেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। দেশটির সরকার একটি আইন জারি করেছিল, যেটি ক্লাব এবং কুয়েত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতো না। যা ফিফার দৃষ্টিতে ছিল তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
ইন্দোনেশিয়া (২০১৫)
ফুটবলের সকল কার্যক্রমের দায়িত্ব সরকার নিজেই কুক্ষিগত করায় ইন্দোনেশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দেশটির পেশাদার ক্রীড়া সংস্থা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একটি অংশ ফেডারেশনে বদল আনতে কমিটি গঠন করেছিল। যার প্রেক্ষিতে ফিফা ইন্দোনেশিয়াকে নিষিদ্ধ করে। পূর্ব এশিয়ার দেশটি ২০১৮ বিশ্বকাপ এবং ২০১৯ এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে খেলতে পারেনি। ২০১৬ সালের মে মাসে তারা নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়।
গুয়েতেমালা (২০১৬ সাল)
ফিফা ২০১৬ সালের অক্টোবরে গুয়েতেমালাকে নিষিদ্ধ করে। দুর্নীতি কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে ফেডারেশন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছিল দেশটির ফুটবল সংস্থা। ২০১৮ সালের জুনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
পাকিস্তান (২০১৭ ও ২০২২ সাল)
অযাচিত তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে ২০১৭ সালে পাকিস্তানকে প্রথমবার নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের (পিএফএফ) অফিস এবং অ্যাকাউন্টগুলো আদালত-নিযুক্ত প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা ফিফার আইনের লঙ্ঘন।
২০১৮ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলেও ২০২২ সালে ফের নিষিদ্ধ হয় পাকিস্তান। নরমালাইজেশন কমিটি থেকে একদল কর্মকর্তা পিএফএফ-র সদর দপ্তরের দায়িত্ব জোর করে কেড়ে নেয়। এটি আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হওয়ায় ফিফা কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। গত মাসে নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হয়েছে পাকিস্তান।
চাঁদ (২০২১ সাল)
আফ্রিকার দেশ চাঁদ ফুটবল ফেডারেশনকে বিলুপ্ত করায় ২০২১ সালের মার্চে ফিফার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। দেশটি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের জন্য (এফটিএফএ) সরকারি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার বিপরীতে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে ছিল।
পরে চাঁদ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের জন্য (এফটিএফএ) সরকার ফুটবলের অস্থায়ী ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। ফেডারেশনের কাছে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়ায় ছয় মাস পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছিল।
জিম্বাবুয়ে (২০২২ সাল)
সরকার নিযুক্ত স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিশন (এসআরসি) জিম্বাবুয়ে এফএর (জিফা) কার্যক্রম স্থগিত করে। এজন্য ফিফা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জিম্বাবুয়েকে নিষিদ্ধ করেছিল। টেকনিক্যাল স্টাফদের দ্বারা নারী রেফারিদের যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং ফেডারেশনে জালিয়াতির অভিযোগের পর সরকার নিযুক্ত স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিশন (এসআরসি) হস্তক্ষেপ করেছিল।
জিম্বাবুয়ের নিষেধাজ্ঞা এখনও চলছে। গত জুলাইয়ে স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিশন ফেডারেশন আগের সদস্যদের পুনর্বহালের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবুও দেশটি ২০২৩ আফ্রিকান নেশন্স কাপে অংশ নিতে পারবে কিনা সে বিষয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
কেনিয়া (২০২২ সাল)
কেনিয়ার ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ফুটবল ফেডারেশন পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক কমিটি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফিফা ফুটবল কেনিয়া ফেডারেশনের কার্যক্রম (এফকেএফ) স্থগিত করে।
২০২১ সালের নভেম্বরে কেনিয়ার ক্রীড়া মন্ত্রী আমিনা মোহাম্মদ ফেডারেশনে আর্থিক অনিয়ম প্রকাশের পর ফেডারেশনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটি কেনিয়ার ফুটবল পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশন কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞার পর ফিফা দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রীর কাছে তত্ত্বাবধায়ক কমিটি নিয়োগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার এবং কেনিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডরিস পেট্রার নেতৃত্বাধীন কর্মকর্তাদের কাছে ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে।