গ্রাম বাঙলার ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার বাউত (হাইত) উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কিশোরগঞ্জের প্রসিদ্ধ ও সুপ্রাচীন রৌহা বিলে। বুধবার (২৫ অক্টোবর) সকালে সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নে এ বিলে চলে মাছ ধরার উৎসব।
বিভিন্ন অঞ্চলের শিশু-কিশোরসহ কয়েক হাজার মাছ শিকারি অংশ নেয় উৎসব-আনন্দে এ বিলে মাছ ধরতে। তবে এবার মাছের দেখা পায়নি কেউ। ফিরেছেন খালি হাতে।
আবহমান বাংলার এমন ঐতিহ্যকে রক্ষায় মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত বিলগুলোকে রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি বলে মনে করেন মাছ শিকার করতে আসা লোকজন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নে সুপ্রাচীন রৌহা বিলের মাছ ধরা উৎসবের ইতিহ্য শত বছরের। প্রায় সাড়ে তিনশত একর আয়তনের এ প্রসিদ্ধ বিলের পরিচিতি এলাকা ছাপিয়ে আশপাশের জেলার মানুষ ও মাছ শিকারিদের কাছে সুপরিচিত।
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের একদিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এ বিলে মাছ ধরার ‘বাউত উৎসব’। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে জাল ও পলোসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে মাছ ধরার এ উৎসবকে বাউত উৎসব বলে ডাকলেও কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে এ উৎসব ‘হাইত উৎসব’ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
বুধবার এ বিলে অনুষ্ঠিত এ হাইত উৎসবে অংশ নিতে এ জেলার লোকজনের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার কয়েক হাজার লোক ছুটে আসে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন যানবাহন এবং পায়ে হেঁটে এসে রৌহা বিল পাড়ের চারপাশে অবস্থান নিতে থাকে এসব লোকজন। ফজরের আজানের আগে থেকেই পলো, জাল, জালি, কোঁচ, এক কাটা, টে কাটাসহ মাছ ধরার নানা ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে বিলের পানিতে নামতে শুরু করে। আনন্দ সূচক ডাক ভেঙে চলে হাজারো মানুষের মাছ ধরার এ উৎসবে। তবে এবার মাছের দেখা মিলেনি। তারপরেও বছরের একদিন সবাই মিলে মাছ ধরতে আসতে পেরে সবাই আনন্দিত।
স্থানীয় বাসিন্দা আপেল মাহমুদ জানান, তিনি ঢাকায় চাকরি করেন। মাছ ধরার জন্য তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী এই রৌহা বিলে প্রতি বছরই হাইতে অনেক মাছ পাওয়া যায়। তাই অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষ হাইতে আসেন। এবার মাছ পাওয়া যায়নি, কারণ মাছের ছোট ছোট পোনা অবৈধ জাল দিয়ে মেরে ফেলার কারণে দিন দিন মাছ কমে যাচ্ছে। অবৈধ জালগুলো বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো উচিত।
মো. আবু তাহের নামে একজন জানান, গত ৪০ বছর যাবৎ তিনি এই বিলে মাছ ধরার উৎসবে আসেন। এবার মাছ না পেয়ে তিনি খালি হাতে ফিরছেন। গত কিছুদিন আগে ভারী বর্ষণের কারণে পানি বেশি হওয়ায় মাছ ভেসে গেছে। এছাড়াও পানি বেশি হওয়ায় জমির ধান গাছ পঁচে পানি নষ্ট হয়ে মাছ মারা গেছে, তাই হয়তো বিলে মাছ কম।
বাবার সাথে মাছ ধরতে আসা নীরব নামে এক কিশোর বলেন, গত বছর অনেক মাছ ধরেছিলাম। এবার মাছ নেই। তাই খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী থেকে রৌহা বিলে মাছ ধরার উৎসবে আসা হারুন নামের এক যুবক বলেন, অনেক দূর থেকে মধ্যরাতে রওনা হয়ে এই বিলে মাছ ধরতে এসেছি। গতবার অনেক মাছ পেয়েছিলাম। এবার মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে কথা হলে চৌদ্দশত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাহার আলী বলেন, আমরা সকলেই এ মাছ ধরা উৎসবের সঙ্গে কম বেশি পরিচিত। শৈশব-কৈশোরে এমন সব মাছ ধরা উৎসবে অংশগ্রহণের অমলিন স্মৃতিও রয়েছে আমাদের। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিক মাছের অভয়াশ্রমগুলো বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে এ প্রজন্মের শিশু-কিশোররা এমন নির্মল আনন্দের মাছ ধরা উৎসব থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও কিশোরগঞ্জের সুপ্রাচীন ও প্রসিদ্ধ রৌহা বিল আজ-ও এমন ঐতিহ্য ধারণ করতে আসাটা সত্যিই গর্ব ও আনন্দের। গ্রাম বাঙলার আবহমান কালের এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির স্বার্থে অবাধে গণ মৎস্য সম্পদ আহরণের এমন অভয়াশ্রমগুলোর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
তিনি মনে করেন, প্রশাসন অবৈধ কারেন্ট জাল ও রিং জাল বন্ধে কঠোর হলে, এমন মাছ ধরার উৎসবে এসে খালি হাতে ফিরতে হবে না কাউকে।