পাশাপাশি দেখে ফেললাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ঘটনাবহুল জীবনের উপর নির্মিত দুটো চলচ্চিত্র। ছবি দুটোর অস্ট্রেলিয়াতে পরিবেশক বঙ্গজ ফিল্মসকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমাদেরকে এই সুযোগটা করে দেয়ার জন্য। শুরুতেই দেখলাম ‘দুঃসাহসী খোকা’। এই ছবিটাতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে কৈশোরের গল্প বলা হয়েছে। আর এই ছবিটার গল্প যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক যেন সেখানটা থেকেই শুরু হয়েছে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’র গল্প।
আমি শুরুতেই দেখেছিলাম ‘দুঃসাহসী খোকা’ ছবিটা শেষ হবার পর মনে হচ্ছিল ছবির কাহিনী আরো একটু দীর্ঘায়িত হলে ভালো হতো। সেটা বলেছিলাম এই ছবিতে অভিনয় করা সৌম্য জ্যোতি এবং উনার মা শাহনাজ খুশিকে। আমার বক্তব্য শুনে শাহনাজ খুশি বললেন, সবাই একই বক্তব্য দিয়েছেন ছবিটি দেখে। এরপর দেখলাম ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। এই ছবির শো’টা ছিল হাউসফুল। এটা দেখে বুঝলাম কেন দুঃসাহসী খোকার কাহিনীকে আর বাড়ানো হয়নি। কারণ এই ছবিটার কাহিনী শুরু হয়েছে আগেরটার কাহিনী যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকে। হতে পারে এটা নিতান্তই কাকতাল। যাইহোক ‘দুঃসাহসী খোকা’ ছবিটাতে দেখানো হয়েছে একেবারে কীভাবে ছোট শেখ মুজিবুর রহমানের মানসচরিত্র গঠন হয়েছে সেটা। সময়ের হিসাবে পরিধিটা তেমন বড় নয়। তাই বোধহয় এই ছবিতে বেশকিছু গান সংযোজন করে ছবিটার দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য সেটা ছিল ছবিটার সাথে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। গানগুলোর সংগীত পরিচালনা এবং গায়কী আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। শুধুমাত্র গানগুলো আলাদাভাবে মুক্তি দিলে আমরা চমৎকার কিছু গান শুনতে পেতাম।
‘দুঃসাহসী খোকা’র চিত্রায়ন মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। সত্যি কথা বলতে যেন দুচোখ ভরে গলাধঃকরণ করেছি। সেট নির্মাণ, আলোক সম্পাৎ, সংলাপ সবই কেন জানি অনেক চেনা এবং আপন মনেহয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়া থাকার কারণেই হয়তোবা দ্রুত রিলেট করতে পেরেছি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। তখন তিনি ছিলেন শুধুমাত্র গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক উঠতি বয়সী কিশোর। সেখানকার প্রকৃতি থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেন কিশোর মুজিবকে ধীরেধীরে একজন রাষ্ট্রনায়ক করে তুলছিল।
কোন অন্যায় দেখলে সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রতিবাদ করতেন সেটার সাথে তাঁর সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক। তার ভাষায় একটা অন্যায় হতে দিলে আরো অন্যায় হতেই থাকবে। তাই নিজে হোস্টেলে না থাকলেও সেখানকার ছাত্রদের হয়ে প্রতিবাদ করে হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় মুজিব ভাই। তিনি মানুষে মানুষে বিভেদ করতেন না। সে যে ধর্মের বা যে গোত্রেরই হোক সবার প্রতিই ছিল তাঁর অসীম মায়া। গরীবদের দুঃখ কষ্ট সবসময়ই তাঁকে বিচলিত করতো। তাই তিনি নিজেদের ধানের গোলা খালি করেও দুঃখী গরিবদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। তাই অসহায় রেনুকে দেখেও তাঁর মন কেঁদে উঠেছিল। আর ছবির শেষ দৃশ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে দাবি জানানো যেন একজন ভাবি জননেতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
এরপর দেখা হলো ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ এই ছবিটা নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক কথা হয়েছে। ট্রেলার মুক্তি দেয়ার পর ছবিটার অনেক অসামঞ্জস্য ধরা পড়েছিল। তখন পরিচালক এবং কুশীলবরা বলেছিলেন যে ছবি দেখে আপনারা বিচার করবেন। ছবি দেখার পর বুঝলাম উনারা কথাটার মূল্য দিয়েছেন। এই ছবির কুশীলবদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো এমন ঘটনাবহুল জীবনকে পর্দায় তুলে আনা তো চাট্টিখানি কথা হয়। যাইহোক প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। যিনি যতটুকু সময় পর্দায় সময় পেয়েছেন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। তবে মেকআপের কথা বলতে হয় আলাদা করে। তারা অভিনীত চরিত্রের সাথে এতটাই মিলে গিয়েছিলেন যে আমি অনেক অভিনেতাকেই চিনতে পারিনি।
শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধবন্ধু হয়ে উঠা থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ঘোষক এবং জনক হয়ে উঠা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্দায় তুলে আনা হয়েছে। শেখ মুজিবের ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়া থাকাতে উনার কারাগারের একাকিদিনগুলোর অসহায়ত্ব টের পাচ্ছিলাম। এই বিষয়টা আমাকে ভীষণরকম অবাক করে। একজন মানুষ মানসিকভাবে ঠিক কতটা দৃঢ় চিত্তের হলে কারাগারের একটা ক্রান্তিকাল পার করতে পারেন। অন্য যেকোন মানুষ হলে পাগল হয়ে যেতেন বলেই আমার বিশ্বাস। এছাড়াও কারাগারের জেলারদের সাথে তাঁর বাৰ্তালাপগুলো দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কারাগারে পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎগুলো এক হৃদয়স্পর্শী পরিবেশের জন্ম দিচ্ছিল। ছোট রাসেলের আব্বা আব্বা ডাকটা এখনও কানে বাজছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন আর সবশেষে স্বাধীনতার ঘোষণার চিত্রায়ন খুবই বাস্তবসম্মত লেগেছে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলিতে দেয়া বক্তব্যটা মনে দাগ কেটেছে। ২৫শে মার্চ কালো রাত্রে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় থেকে যাওয়াটা কতখানি যৌক্তিক ছিল সেটা এখন অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। নিজ হাতে স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া এবং সেটার অনুলিপি তৈরি করাটা দেখানো হয়েছে খুবই বাস্তবসম্মতভাবে। দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পর ভারতীয় সাংবাদিকের উত্তরে দেয়া বক্তব্যটা যেন একেবারে বাস্তবতার প্রতিফলন। এরপর বাকশাল গঠন উপলক্ষে ভাষণ। সবই যেন বাস্তবতার প্ৰতিচ্ছবি।
তবে যে বিষয়টা নিয়ে আমার ভীতি ছিল সেটা এই প্রথম চাক্ষুষ দেখাটা ছিল এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। ১৫ আগস্ট কালরাত্রি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে। তাই বজলুল হুদাকে দেখে বন্ধবন্ধুর বলে উঠা-‘এই তুমি বজলুল হুদা না, তোমার বাবা কুষ্টিয়াতে আওয়ামীলীগ করে’ বক্তব্য শুনে আমি মোটেই আশ্চর্য হইনি। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তিধর একজন মানুষ। তাঁর স্মৃতিশক্তি নিয়ে কত যে গল্প পড়েছি এবং শুনেছি। আমি কেঁদে উঠলাম ইতিহাসের সেই চরমতম সময়টা দেখে যখন দ্বিতীয় সৈন্য এসে কথা না বলেই গুলি চালিয়ে দেয়। আমি যতদূর পড়াশোনা করেছি এটা জানি যে যারা উনাকে হত্যা করতে গিয়েছিল তাদেরকে একটা কথায় বলে দেয়া হয়েছিল- ‘ডোন্ট লেট হিম টক’। কারণ বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বই এমন ছিল যে উনি শুধু কথা বলেই ঘটনার চাল নিজের দিকে নিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখতেন।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে আরিফিন শুভ সাবলীল অভিনয় করেছেন। রেনু চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা ছিলেন অনবদ্য। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে মানিক মিঞার চরিত্রে তুষার খানকে ভালো লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর পিতার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী এবং খায়রুল আলম সবুজ নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। অনেকদিন পর খায়রুল আলম সবুজকে দেখলাম তাই ছবিটা দেখার সময় চিনতে পারিনি। আবারো জাত চিনিয়েছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু। আর আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ হয়ে উঠেছিলেন যেন আসল লাল মাওলানা। প্রবীণ নারীর ভূমিকায় রোকেয়া প্রাচী এতটাই ভালো অভিনয় করেছেন যে তাকে চিনতেই পারিনি। চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচন একদম সঠিক ছিল বলেই আমার ধারণা।
শেখ মুজিবুর রহমান তো আসলে শুধু একটা নাম নয়। উনি একইসাথে শেখের পো, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু আবার কখনও মজিবর। কত নামেই না উনাকে ডাকা হতো। কিন্তু উনার যে পরিচয়টা অন্য পরিচয়কে আড়াল করে সেটা হচ্ছে উনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশের জাতির জনক। একটা মানুষের অঙ্গুলি হেলনে সাত কোটি মানুষ চলাফেরা করতো। যার অনুপস্থিতি যেন আরো বেশি করে উপস্থিতি ঘোষণা করতো। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার জন্য উনার বেঁচে থাকার দরকার ছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেট সেটা হতে দেয়নি। তবুও তিনি যেন রয়ে গেছেন আমাদের অন্তরে। আমরা নিয়তই উনার উপস্থিতি অনুভব করি। এখনও আমরা আমাদের ব্যক্তিত্ব, সাফল্যের মাপকাঠি হিসাবে উনাকেই মানি।
বাংলাদেশে যতদিন থাকবে ততদিন উজ্জ্বল থাকবে একটি নাম শেখ মুজিবুর রহমান। গানের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে –
“শোনো, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।।”