গণমাধ্যম ও মামলার সূত্র মোতাবেক জানা যায়; ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামীণ টেলিকম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণ ফোনের ৩৪.২% শেয়ারের মালিক। গ্রামীণ ফোন থেকে প্রতিবছর প্রায় হাজার কোটি টাকা মুনাফা পেয়ে থাকে গ্রামীণ টেলিকম।
শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী যে কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীগণ প্রতিষ্ঠানটির মোট মুনাফার ৫% লভ্যাংশ পাওয়ার কথা থাকলে গ্রামীণ টেলিকম নিজেদের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দাবি করে শ্রমিক কর্মচারীদের কোন লভ্যাংশ প্রদান করেনি। লভ্যাংশ প্রাপ্তির দাবি নিয়ে ২০১৭ সালে ২৭ জন শ্রমিক কর্মচারী শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করে।
পরবর্তী আরও শ্রমিক কর্মচারীগণ মামলা দায়ের করলে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। মামলা দায়ের সত্ত্বেও লভ্যাংশ প্রদান না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে গ্রামীণ টেলিকম। উপরন্তু, ২০২০ সালে কোভিড মহামারী চলাকালীন সময়ে এক নোটিশে গ্রামীণ টেলিকমের ৯৯ জন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করে গ্রামীণ টেলিকম।
অর্থাৎ মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ চাকুরি ফিরে পায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীরা। লভ্যাংশ প্রাপ্তির মামলাসমূহে আইনী প্রতিকার না পেয়ে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘গ্রামীণ টেলিকম’ কোম্পানির অবসায়ন চেয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের পক্ষ হতে রিট পিটিশন দাখিল করা হয় উচ্চ আদালতে। উক্ত রিট পিটিশনে ড. ইউনূস এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা, গ্রামীণ টেলিকমের শত শত কোটি টাকা অন্যত্র স্থানান্তর, লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগের মাধ্যমে আদালতে প্রভাবিত করে চলমান মামলাসমূহের রায় নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের পূর্বক কোম্পানিটির অবসায়ন ঘটিয়ে কর্মচারীদের পাওয়া বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানের সময় দুর্নীতির মাধ্যমে শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে গত ৩০ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পরিষদের আট পরিচালক, তিন শ্রমিক নেতা এবং শ্রমিকদের দুই আইনজীবীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। এই মামলার অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বাকি অভিযুক্তদের ৪ ও ৫ অক্টোবর দুদকে তলব করা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর থেকে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বিবৃতি প্রদান করেছেন দেশে বিদেশের নানান বিখ্যাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুদকে তলব করায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী ব্যরিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমে দাবি করেছেন হয়রানি করার জন্যই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তদন্ত কিংবা বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এই ধরনের বিবৃতি প্রদান কতটা আইনসংগত সেই আলোচনায় না গিয়ে আমরা জানার চেষ্টা করব দুদক কেন মামলা দায়ের করেছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে, কী ছিল মামলার প্রেক্ষাপট, কী অভিযোগ আনা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে। উক্ত রিট পিটিশনটি আদালত কর্তৃক মামলা হিসেবে গৃহীত হলে গ্রামীণ টেলিকম তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার এবং বাধ্যতামূলক অবসরে যাবার শর্তে শ্রমিক কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানে সম্মত হয়। এটি সহজেই অনুমেয় যে, গ্রামীন টেলিকম যদি নিজেদের অবস্থানে আইনী ভাবে এবং নীতিগতভাবে সঠিক হতো তাহলে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে শ্রমিক কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানে রাজি হত না। বরং আদালতের বিচারের মাধ্যমেই এই সুরাহা করত। তা না করে লভ্যাংশ প্রদানে রাজি হওয়াই প্রমান করে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জেনেশুনে কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিলেন।
লভ্যাংশ প্রদানের জন্য গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের মাঝে ২৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে একটি সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। ৯ মে, ২০২২ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের ১০৮তম পরিচালনা পরিষদের সভায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের ৪৩৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পরিচালনা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০মে, ২০২২ তারিখে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় গ্রামীণ টেলিকম নামে একটি পৃথক একাউন্ট খোলা হয় এবং তাদের ৪৩৭ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকম হতে স্থানান্তর করা হয়। এই টাকার পুরোটাই শ্রমিক কর্মচারীদের লভ্যাংশ হিসেবে পাবার কথা থাকলেও তাদের লভ্যাংশ প্রদান শুরুর পূর্বেই উক্ত একাউন্ট হতে ২৬ কোটি ২২ লক্ষ টাকা ডাচ বাংলা ব্যাংকে থাকা ‘গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’ নামীয় পৃথক একটি একাউন্টে সরিয়ে নেয়া হয়।
উক্ত অর্থ হতে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ের তিন নেতা মোঃ কামরুজ্জামান, ফিরোজ মাহমুদ হাসান এবং মো. মাইনুল ইসলাম প্রত্যকে ৩ কোটি টাকা করে গ্রহন করে।
এছাড়াও শ্রমিক কর্মচারীদের আইনজীবী এডভোকেট ইউসুফ আলী এবং এডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফকে দেয়া হয় সর্বমোট ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ শ্রমিক কর্মচারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশের অর্থ হতে গ্রামীণ টেলিকম তাদের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিন শ্রমিক নেতা ও দুই আইনজীবীকে ২৫ কোটি টাকা বেআইনীভাবে প্রদান করে। মূলত এই অপরাধেই তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করেছে।
ড. ইউনূসের মামলার বিষয়ে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়। প্রথমত, শ্রমিক কর্মচারীদের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রম আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট বিধি বিধান রয়েছে। এর জন্য পৃথক কোন সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টের প্রয়োজন নেই। তাহলে গ্রামীণ টেলিকম কেন শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে পৃথক সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট করতে গেল? আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য পাওয়া বুঝিয়ে দিলেই তো হতো।
অর্থাৎ এই সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টটি করাই হয়েছে শ্রমিক নেতা এবং আইনজীবীদের অবৈধ সুবিধা প্রদানের জন্য এবং তা পরিচালনা পরিষদ তথা ড. ইউনূসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ব্যতীত অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ টেলিকম কেন শ্রমিক কর্মচারীদের আইনজীবীদের আইনী ফি প্রদান করল? কখনো কি কেউ শুনেছেন যে বিবাদীপক্ষ বাদী পক্ষের আইনজীবীর খরচ বহন করে? গ্রামীণ টেলিকম তার শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য পাওয়া বুঝিয়ে দেয়ার পর শ্রমিক কর্মচারীরাই তো আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করতে পারত। কিন্তু তা না করে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিকদের দুই আইনজীবীকে কেন ১৬ কোটি টাকা প্রদান করল? অবাক করা বিষয় হলো উক্ত ১৬ কোটি টাকার মাত্র এক কোটি টাকা জমা হয়েছে আইনজীবীদের ল’ফার্মের একাউন্টে আইনজীবী ফি হিসেবে। বাকি ১৫ কোটি টাকা দুই আইনজীবী ভিন্ন ভিন্ন একাউন্টে সরিয়ে নেন। ৬ কোটি টাকা দিয়ে তারা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক একটি যৌথ হিসাব খোলেন যেখানে তাদের পরিচয় দেয়া হয় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামক একটি এনজিওর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে।
তারা যদি আইনসঙ্গত ভাবেই ফি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে কেন তারা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে একাউন্ট খুলে সেই টাকা স্থানান্তর করল। কী করা হতো এই টাকা দিয়ে? তৃতীয়ত, তিন শ্রমিক কর্মচারীকে গ্রামীণ টেলিকম কেন তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশের অতিরিক্ত ৯ কোটি টাকা প্রদান করল? আইন অনুযায়ী বাকি শ্রমিকদের মতো তারাও তো তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশ পেয়েছে। কিন্তু তার বাইরে এই অতিরিক্ত টাকা কেন দেয়া হলো তাদের? যেখানে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছে তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেখানে কোন সমঝোতার মাধ্যমে কিংবা কিসের কারণে এই আইনজীবী ও শ্রমিক নেতাদের প্রায় ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত দেয়া হলো? এসব প্রশ্নের উত্তরও পেলেই সামগ্রিক মামলার আদ্যোপান্ত বের করা সম্ভব হবে। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পরিষদ অনিয়ম করেছেন। তিন শ্রমিক নেতা এবং দুই আইনজীবীর সাথে যোগসাজশে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত করেছেন। কাজেই ব্যাপারটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত না করে মামলার সুরাহার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে এ প্রত্যাশাই করে এ দেশের জনগণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)