সকালের সূর্য, ভোরের কুয়াশা, ঠাণ্ডা বাতাস, রাতের জোছনায় সবখানেই তিনি আছেন। আছেন উপর থেকে আসা প্রকৃতির মাঝে। আছেন তাঁর করা কাঁচা রাস্তায়, তাঁর হাতে গড়া স্কুলে, (যেই স্কুলের তিনি হেড মাস্টার ছিলেন)। আছেন অসংখ্য অগনিত তাঁর স্টুডেন্টদের মনের ভিতরে। যারা কেউ শিক্ষক, প্রিন্সিপাল, এস পি, প্রফেসর, বড় অফিসে চাকরি করেন ইত্যাদি। বেশির ভাগ সবাই শুনেই দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন জানাযায় অংশ নিতে প্রিয় শিক্ষকের জন্যে। জানাযায় নেমেছিল হাজার হাজার মানুষের ঢল। তিনি আছেন পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া অঞ্চলের সমস্ত মানুষের অন্তরস্থলে।
তারা জানালেন,‘যখন শিক্ষা ছিল মাঝ অন্ধকারে, ঠিক সেই অন্ধকারে তিনিই বাতি ধরেছিলেন। সাথে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী শেফালী, তিনিও একজন শিক্ষক ছিলেন।’ এ ছাড়া তাঁর পরিবারের অন্যান্য দুইজন ভাইও শিক্ষক ছিলেন। জানাযায় ইমাম অনেক কথার মাঝে বললেন,‘আজ বাতি জ্বালানোর মানুষটি চলে গেলেন’। কারণ, যত ভালো ভালো কাজ এই গ্রামের জন্যে তিনিই উদ্যোগ নিয়ে করতেন।
তাঁর করা কাঁচা রাস্তা দিয়েই আজ তিনি এলেন অন্য এক গাড়ি করে। তখন গাড়ির চাকায় ভোর সকালের বাতাসে ধূলো উড়ে যাচ্ছিল। এই পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় আমাদের পরীমণি হচ্ছে শুধুমাত্রই শামসুল হক গাজীর নাতনি। আর কিছুই না। সত্যিই তাই। আমাদের নানুভাই, তিনি যে এই গ্রামে কী পরিমাণ জনপ্রিয় আর ভালোবাসার মানুষ! নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো।
বাড়ির প্রতিটি মানুষ সুশিক্ষিত, আস্তে কথা বলে। সকলেই ভদ্র, বিনয়ী,মানবিক আর অতিথি পরায়ণ। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এই যে গাজী শামসুল হক হচ্ছেন এই অঞ্চলের বটগাছ। সব্বাই যে কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছেই আসতেন দৌড়ে। এই সমস্ত যা কিছু লিখছি আজ প্রতিটি শব্দ, কথা, বাক্য নিজের কানে শুনে, চোখে দেখে লিখছি। লিখতে বসে চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে।
আজ মিলাদ। তিনদিন হয়ে গেলো দেখতে দেখতে। নানুভাই, যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন। নিশ্চয়ই তিনি দেখছেন হাজার হাজার মানুষের চোখের জল। আর সেই জলে তিনি ভাসছেন ভালোবাসায়। জানিনা পরীমনি আর কখনোই পায়েস খেতে পারবে কিনা! কিন্ত তাঁর নানুভাই হাসপাতালের শেষদিন অবধি তার রান্না করা পায়েসই খেয়েছিলেন। বলেছিলেন,‘পরীর পায়েস ছাড়া আর কিছুই খাবো না আমি।’
আজও সেই পায়েস রান্না করা হচ্ছে সবার জন্যে। তিনি নিশ্চয়ই উপর থেকে সব দেখছেন আর পরীকে দোয়া দিচ্ছেন যাকে আজীবন রেখেছেন আগলে তাঁর বুকের ভিতর। শেষ মুহূর্ত অবধি বলেছিলেন,‘পরী নানুভাই তুমি আমার বুকের ভিতর আছো।’
শ্রদ্ধা আর প্রণাম নানুভাই। আমি অনেক ভাগ্যবান আপনার মত একজন মানুষের আশির্বাদ দোয়া পেয়েছি। পেয়েছি স্নেহ আর ভালোবাসা। পেয়েছি সাপোর্ট। দেখেছি কত আধুনিক আপনি। কী দারুণ ইংরেজিতে কথা বলেন! কখনই নামাজ পড়তে ভুল হয়না আপনার। আপনার কথা আজীবন মনে থাকবে নানু ভাই। কখনই ভুলবো না। স্যালুট আমাদের বাতি, আমাদের নানুভাই শামসুল হক গাজী।
লেখক: চয়নিকা চৌধুরী, নির্মাতা
ঢাকা/এমটিএল