বিষাক্ত বাতাসে জেরবার অবস্থা ভারতের রাজধানী দিল্লির। রীতিমতো গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে রাজধানী। কোনও নির্দিষ্ট একটি বা দুটি এলাকা নয়, গোটা দিল্লিতেই এই পরিস্থিতি। দূষিত বাতাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি রোগীদের ভিড়। চোখের সমস্যাও বাড়ছে ক্রমশ। দূষণ প্রতিরোধে ইতিমধ্যেই দিল্লি সরকার নিয়েছে নানান পদক্ষেপ। কিন্তু তাতেও কমছে না দূষণের মাত্র। এই পরিস্থিতিতে দূষণ কমাতে ‘কানপুর আইআইটি’র সহায়তায় কৃত্রিম বৃষ্টি বা ক্লাউড সিডিংয়ের পরিকল্পনা করছে কেজরিওয়াল সরকার।
বিবিসি জানিয়েছে, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং বেশ কয়েকটি ফেডারেল মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার ওপর। যদি তা ঘটে, তবে আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এই মাসের শেষের দিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে পারে।
দিল্লিতে বায়ু দূষণের সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে এর আগেও ক্লাউড সিডিংয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তখন কিছু বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এটি একটি জটিল ও ব্যয়বহুল পদক্ষেপ এবং এর কার্যকারিতা দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত নয়। এর দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাব বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
গত দুই সপ্তাহে দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৪৫০ মাত্রা অতিক্রম করেছে যা গ্রহণযোগ্য সীমার থেকেও প্রায় ১০ গুণ বেশি। এই অবস্থায় দীপাবলি উৎসব উদযাপন করতে আতশবাজির ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে গেছে।
ক্লাউড সিডিং কী?
ক্লাউড সিডিং হল কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটানোর একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া।
এর জন্য উড়োজাহাজ বা ড্রোনের সাহায্য মেঘের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয় সিলভার আয়োডাইড বা পটাশিয়াম আয়োডাইড। এই আয়োডাইড মেঘে ঘনত্ব বাড়াতে কাজ করে। মেঘে ঘনত্ব বাড়লে বৃষ্টিকণা তৈরি হয়, ফলে বৃষ্টি বা বরফপাত হয়। দিল্লির ক্ষেত্রে বৃষ্টি নামানো হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সবসময় কাজ করে না।
এই বিষয়ে বায়ুর গুণমান এবং স্বাস্থ্য গবেষক পলাশ মুখার্জি বলেছেন, এটি ঘটাতে হলে বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থাকে সম্পূর্ণ সঠিক হতে হবে। বরফের নিউক্লিয়াস গঠনের জন্য মেঘে আর্দ্রতার পরিমাণ সঠিক থাকা উচিত। তিনি বলেন, বাতাসের গতিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ২০১৮ সালে আবহাওয়া বিজ্ঞানী জেআর কুলকার্নি বলেন, ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য লবণের কণাগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ধরনের মেঘে স্প্রে করতে হয়।
কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। ১৯৬০ এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনী যুদ্ধের সময় ভিয়েতনামের সামরিক সরবরাহ ব্যাহত করার জন্য ভিয়েতনামের নির্দিষ্ট এলাকায় বন্যার সৃষ্টি করতে কৌশলটি ব্যবহার করে। তাছাড়া চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কিছু ভারতীয় রাজ্যও বৃষ্টিপাত বাড়ানো বা খরা মোকাবেলায় এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
পরিকল্পনাটি কবে বাস্তবায়ন হতে পারে?
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) কানপুর এর কয়েকজন গবেষক প্রথম এই কৃত্রিম বৃষ্টির পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রকল্পটি দুই ধাপে সম্পাদিত হবে। প্রথম ধাপে প্রায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাতে কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী ২০ এবং ২১ নভেম্বর পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে হবে কারণ সেই সময়ে আবহাওয়া পরিস্থিতি আদর্শ হবে।
প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী মনীন্দ্র আগরওয়াল বলেছেন, আমরা ওই সময় পুরো দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানোর আশা করছি না তবে কয়েকশ কিলোমিটার এলাকাতে তা সম্ভব হতে পারে।
এটা কী সত্যিই দূষণ কমাতে সাহায্য করবে?
বৃষ্টিপাত বায়ুমণ্ডলের দূষিত কণাকে ধুয়ে ফেলতে সাহায্য করে, বায়ুকে পরিস্কার করে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী করে তোলে। গত শুক্র এবং শনিবার দিল্লিতে সামান্য পরিমাণ বৃষ্টি হয়। এরপর দূষণের মাত্রা কিছুটা কমে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বৃষ্টি কতটা সহায়ক হবে তা স্পষ্ট নয়।
পলাশ মুখার্জি বলেছেন, ক্লাউড সিডিং অন্যান্য দেশে বায়ুর গুণমান ব্যবস্থাপনা এবং ধূলিকণা দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আপনি যদি বাতাসের মানের ওপর বৃষ্টিপাতের প্রভাব দেখেন তবে তা অবিলম্বে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনে। কিন্তু ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা পুনরায় ফিরে আসে। তিনি জানান, এটি খুবই ব্যয়বহুল পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, আমরা এখনও দিল্লির বাতাসে এর প্রভাব সম্পর্কে অবগত না। কারণ এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে কৃত্রিম উপায়ে ঘটানো হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু বৃষ্টি এবং বাতাসের গতির মতো আবহাওয়া সংক্রান্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে দূষণের সমাধান করা যাবে না। আমাদের বায়ু দূষণ রোধে আরও সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা চালাতে হবে।