চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের অর্থ ফেরত আনাটাই এখন মূল এজেন্ডা হওয়া উচিৎ

KSRM

ওটিটিতে গত ১৪ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ শিরোনামের একটি প্রামাণ্যচিত্র। যে প্রামাণ্যচিত্রের মূল বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং-এর ঘটনা। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একদল হ্যাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক করে। ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ শিরোনামের এই প্রামাণ্যচিত্রে ব্যাংকের ডাকাতিকে একটি ডেটা পয়েন্ট হিসেবে একটি বৃহত্তর ক্যানভাসে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখানো হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাইবার ক্রাইম কতটা পরিশীলিত এবং প্রচলিত হয়ে উঠেছে। এর ভয়াবহ বিপদ কি হতে পারে তারও কথা বলা হয়েছে।

‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ প্রামাণ্যচিত্রটিতে বিশ্বখ্যাত একদল সাইবার বিশেষজ্ঞদের হাজির করেছেন পরিচালক ডানিয়েল গর্ডন। পুরো প্রামাণ্যচিত্রটিতে ঘটনার বর্ণনায় আছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মিশা গোনি। এই প্রামাণ্যচিত্রের নিমার্ণশৈলী এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। আবার কারো কারো বক্তব্যকে অস্বাভাবিক করার চেষ্টাও করা হয়েছে। তবে এমন একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পেছনে কী কূটকৌশল বা বাণিজ্য আছে সেটা অনেকটাই নিঃসন্দেহে রহস্যময়। তবে শেষ পর্যন্ত এটি একটি ফিল্ম। তাই অনেক মনগড়া তথ্যও রয়েছে। তাই বিনোদনমূলক এই চলচ্চিত্রকে বাংলাদেশের কতিপয় পত্রিকা যখন তথ্য প্রতিবেদন হিসেবে প্রথম পাতায় স্থান দেয় তখন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

Bkash July

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং-এর ঘটনা সেসময় শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বইকে নাড়া দেয়। বিশ্বের বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও এমন ঘটনায় বিস্মিত হন। গত সাত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং-এর ঘটনা নিয়ে অনেক ধরনের লেখালেখি, কথাবার্তা, মূল্যায়ন হয়েছে। তবে ঘটনার নির্মোহ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের চেয়ে অন্ধ আবেগই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। ঘটনার গভীরে যাওয়ার আগে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সাইবার হামলা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকলেও অনেকেই এমনভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক যেনো হ্যাকারদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে এসেছে। বিষয়টিতে দ্রুত রাজনৈতিক রঙ ও দেয়া হয়। ফলে রিজার্ভ হ্যাকিং-এর ঘটনার নানান ধরনের হাত পাও বের করে ফেলা হয়। সাজানো হয় সব অলীক গল্পগুজব। অনেকক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত আক্রমণ বা আক্রোশের দিকেও ধাবিত হয়।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, এটি ছিল স্মরণকালের দুঃসাহসী সাইবার হামলা। যা করতে হ্যাকাররা অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সংঘটিত এই রিজার্ভ হ্যাকিংকে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবারই বলেছে এটি দুঃসাহসী সাইবার হামলা। বিশেষ করে দীর্ঘ তিন বছর ধরে অনুসন্ধান করে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

Reneta June

সেই প্রতিবেদনে এই ঘটনাটি বাইরের হ্যাকারদের কাণ্ড বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাদের দোষ দেয়া হয়নি। বরং তারা এই আক্রমণের শিকার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত এই প্রতিবেদনের কারণেই এ বছর গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক ফেডারেল কোর্টে করা মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর আগে এরকম সাইবার হামলার ঘটনা কখনই ঘটেনি। একই সাথে এও সত্য যে এই সাইবার হামলাতে হ্যাকারদের ফিলিপিনো সহযোগীদের নকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা ও ক্যাসিনোর বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক-এর সন্ধান মেলে। আবার সাইবার অপরাধ জগৎ যে এভাবে বিস্তৃত হয়েছে-তারও এক নতুন অবয়ব ধরা পড়ে বিশেষজ্ঞদের কাছে। এই ঘটনার পর সবদেশেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর রিজার্ভ হ্যাকিং-এর বিষয়টি নিয়ে আবার চলছে মুখরোচক আলোচনা। দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক হলিউডে মুক্তি পাওয়া ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’কে উপলক্ষ করে পর পর দুদিন বড় করে রিজার্ভ হ্যাকিং-এর আদ্যপান্ত নিয়ে রিপোর্ট করেছে। কিন্তু সেই রিপোর্টে পুরনো ঘটনাপ্রবাহগুলো আবার নতুন করে বলা হয়েছে মাত্র। রিপোর্টে ঠিক সেই অর্থে নতুন কোনো অনুসন্ধান নেই। এই কথা এই অর্থে বলছি যে, বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। এ কথাও ঠিক কোথাও বলা হয়নি যে সম্প্রতি নিউইয়র্ক কোর্টে ইতিবাচক রায়ের কথা।

এ বিষয়টি সত্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং-এর ঘটনায় পক্ষে বিপক্ষের নানা মতের মধ্যে একটি বিষয় বারবার স্পষ্ট হয়েছে যে, এই অর্থ হ্যাকিং- এর ঘটনার দায় কিন্তু কোনোভাবেই এড়াতে পারে না ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারমেশন না পেয়েই কিন্তু পেমেন্টে দেয়া হয়। অথচ অন্য একই ঘটনার ক্ষেত্রে অন্য পেমেন্টগুলো দেওয়া থেকে তারা বিরত থাকে। কিন্তু কোনো কনফারমেশন ছাড়াই তারা পাঁচটি পেমেন্ট দিয়ে দেয় অথচ এ টাকাগুলো তাদের কাছে গচ্ছিত আকারে রাখা হয়েছিল। তাদের মতো উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভাঙ্গলো কি করে, তাদের একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন কেন ছিল না এসব প্রশ্নও তোলেনি এসব ‘বড় বড় সাংবাদিকরা’। কিন্তু এও আবার সত্য যে বাংলাদেশের দ্রুত তৎপর হওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কারণেই বেশ কিছু টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল।

আগেই বলা হয়েছে, সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া রিজার্ভের মামলার রায়ও কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আসে এ বছরের প্রারম্ভে। বাংলাদেশের জন্য এটিও ছিল একটি বড় অগ্রগতি। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, এখন থেকে চুরির সাথে জড়িত ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) ও অন্যান্য ১৮ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা পরিচালনায় কোনো বাধা থাকলো না। জানা যায়, সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিং হওয়া অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে (স্টেট কোর্ট) আরসিবিসি ও অন্যান্য ৬ জন বিবাদীর দায়ের করা ‘মোশন টু ডিসমিস’ আবেদন ১৩ই জানুয়ারি আদালত খারিজ করে দেয়। একইসঙ্গে অভিযুক্ত কিম অং এর দায়ের করা মোশন টু ডিসমিসও খারিজ করে আদালত। এর ফলে মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে সমস্ত বাধা অপসারিত হয়।

এর আগে ২০১৯ সালে চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দি সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্কে আরসিবিসিসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি দায়েরের পর আরসিবিসিসহ ৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ‘মোশন টু ডিসমিস’ আবেদন করেছিল।রিজার্ভ চুরি

এরপরে ২০২০ সালের মার্চ মাসে ফেডারেল আদালত ফিলিপাইনের বিভিন্ন বিবাদীর দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলাটি ফেডারেল কোর্টের পরিবর্তে স্টেট কোর্টে পরিচালনা নির্দেশ দেয়।

এর পরে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে আরসিবিসিসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এখানে মামলাটি দায়ের করার পর ৬ জন বিবাদী ফেডারেল কোর্টের মতো মোশন টু ডিসমিস আবেদন করে। বিবাদী পক্ষের আবেদনের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৪ই জুলাই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ই জানুয়ারি স্টেট কোর্ট বিবাদীদের দায়ের করা মোশন টু ডিসমিস খারিজ করে দেয়।

শুধু তাই নয় ঐ রায়ের উপসংহারে অরসিবিসি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ‘মেডিয়েশন’ বা আলাপ আলোচনা করে সমাধানে বসে টাকা ফেরত দেবার কথা বলা হয়েছে। যতটুকু জানা যায়, উভয়পক্ষের আইনজ্ঞরা এ বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। গত কয়েকবছরে কিছু এ বিষয় স্পষ্টত প্রমাণিত হয়েছে যে, রিজার্ভ হ্যাকিং ছিল শ্রেফ দুর্ঘটনা। এখানে ব্যাংকের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পক্ষে ইচ্ছেকৃতভাবে কোনো কিছুই ঘটানোর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া অর্থের মধ্যে ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার। বাদবাকি অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইনি লড়াই চলছে।

বাংলাদেশের উচিৎ কারো প্ররোচনা, কারো উল্লাস ও উচ্ছ্বাসে শরীক না হয়ে টাকা ফিরিয়ে আনার জোর আইনি লড়াইটাকে এগিয়ে নেয়া। এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরি করে উপরে উল্লিকিত আইনজ্ঞদের নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করাটা বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমেরই উচিত হবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View