প্রতারণার ফাঁদ ‘র্যাপিড ক্যাশ’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে ক্রিপটো কারেন্সি বিট কয়েনে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লেনদেন করেছে মূলহোতা মহিউদ্দিন মাহির। চীনে লেখাপড়া করে চীনা দুই নাগরিককে নিয়ে এই প্রতারণার ফাঁদ পাতা মহিউদ্দিন গ্রেপ্তার হলেও এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে চক্রের মাস্টারমাইন্ড দুই চীনা নাগরিক। পুলিশ বলছে, তাদের নজরদারিতে রয়েছে দুই চীনা নাগরিক। এই দুই মাস্টারমাইন্ডকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় এক ভুক্তভোগী এই চক্রের হাতে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে মামলা তদন্তে চক্রটির সন্ধান পায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের একটি কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে এর পরিচালক মহিউদ্দিন মাহিরসহ ২৬ জনকে আটক করেছে এটিইউ’র সাইবার ক্রাইম শাখা।
র্যাপিড ক্যাশ কী?
এটিইউ বলছে, র্যাপিড ক্যাশ একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন। মোবাইলে ডাউনলোড করার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটির সম্পূর্ণ এক্সেস নিয়ে নেয় অ্যাপটি। যার মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীর সমস্ত কন্টাক্ট নম্বর, গ্যালারি তথ্য ছবি এবং ভিডিও এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য যে কোন মোবাইল সিমের নম্বরের মাধ্যমে অ্যাপটি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হয়।রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই র্যাপিড ক্যাশ ব্যবহারকারীকে অন্তত ৫০০/এক হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে এবং সেদিন থেকেই ওই টাকার উপর প্রায় ৪০ থেকে একশ টাকা হারে সুদ আরোপ করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই লোন পরিশোধের জন্য বা কমপক্ষে সুদের টাকা পরিশোধ করার জন্য র্যাপিড ক্যাশ তাদের হটলাইন নাম্বার (০১৯৫৬৭২৮৭৭৬ এবং অন্যান্য) এর মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন প্রদান করে। কোন গ্রাহক যদি এই উচ্চ হারের সুদ প্রদানে অস্বীকৃতি প্রদান করে তবে তাকে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করা শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়- গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয় তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশের হুমকি। ব্যবহারকারী নিজের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে যখন ঋণ এবং সুদের টাকা প্রদানে সম্মতি প্রদান করে তখন র্যাপিড ক্যাশ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নাম্বার প্রদান করা হয়।
যেভাবে হয়েছে প্রতারণা
জানা যায়, সহজ শর্তে ঋণের কথা বলে অ্যাপস ইনস্টল করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহকের মোবাইলের সব ধরনের তথ্য নিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর অল্প করে ঋণ দিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় ৪০ থেকে শতগুণ টাকা। নির্ধারিত দিনে গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বা আরও কিছুদিন টাকা দিতে না পারলে শতকরা হিসেবে বার্ষিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয় র্যাপিড ক্যাশ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদ হারের প্রায় সাড়ে ৫ গুণ বেশি। এছাড়া ভ্যাটসহ আবেদন প্রক্রিয়াকরণের নামে তারা যে ফি নিচ্ছে তা বৈধ কোনো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান নেয় না। ঋণের টাকা পরিশোধ না করলে গ্রাহকের সব ডাটা, ছবি, ভিডিওসহ গোপনীয় তথ্যাদি ফাঁসের হুমকি দিয়ে ব্লাকমেইলও করছে প্রতিষ্ঠানটি।
র্যাপিড ক্যাশের র্যাপিড ঋণ প্রতারণা
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় র্যাপিড ক্যাশের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে গ্রাহকের কখনো দেখা হয় না। সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় অ্যাপের মাধ্যমে। র্যাপিড ক্যাশ থেকে অনলাইনে ঋণের টাকা চলে আসে গ্রাহকের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে। তবে একজন গ্রাহককে ২ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে দেওয়া হয় ১৬৮৫ টাকা। কেটে রাখা হয় ৩১৫ টাকা।
মাত্র ৫ টাকা সুদে ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে ঋণ দেওয়ার পরই আবেদন ফি ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা এবং ভ্যাট চার্জ হিসেবেও ১৫ টাকা কাটা হয় গ্রাহকেরই। যদিও ঋণ নেওয়ার আগে টাকা কাটার বিষয়ে কোনো তথ্য গ্রাহক জানতে পারে না বা জানানো হয় না।
আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির ১৫জন এজেন্টের সন্ধান পেয়েছি। যার মধ্যে পাঁচ এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে চার কোটি ঋণের টাকা আদায়ের তথ্য মিলেছে। একেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার ঋণ আদায় করা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো ঋণ আদায় হতো ১৫ অ্যাকাউন্টে। আরও অ্যাকাউন্ট আছে, সেগুলো আমরা খুঁজছি।
চীনে পড়াশোনা, ‘চীনাদের নিয়েই’ প্রতারণা
প্রতারণার মূলহোতা মহিউদ্দিন মাহিরের বাড়ি ঢাকার রমনা থানাধীন শান্তিনগরের নিউ ইস্কাটনে। তার বাবার নাম গোলাম মোহাম্মদ। তিনি প্রভাতি উচ্চ বিদ্যা নিকেতন থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও বসুন্ধরা হামদর্দ পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে এক বছর মেয়াদি চীনা ভাষার উপরে কোর্স করেন।
এটিইউ সাইবার ক্রাইম শাখার পুলিশ সুপার ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, চার বছরের স্কলারশিপ নিয়ে চীনে যান মহিউদ্দিন মাহির। সেখানেই চীনা প্রতারক চক্রের মাধ্যমে র্যাপিড ক্যাশ অ্যাপস সম্পর্কে পরিচয় তার। ২০২০ কিংবা ২০২১ সালে ফিরে বাংলাদেশে অত্যন্ত গোপনে তিনি র্যাপিড ক্যাশ অ্যাপসে ঋণ প্রতারণা শুরু করেন। গ্রেপ্তার মাহির কথায় অনেক পটু। কীভাবে মানুষকে ভয় দেখাতে হবে, কি বললে টাকা আদায় করা যাবে তিনি সবই জানেন।
বিট কয়েনে আড়াই কোটি টাকার লেনদেন
ক্রিপটো কারেন্সি বিট কয়েনে আড়াই কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে দাবি করে এটিইউয়ের পুলিশ সুপার ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, আমরা যেসব ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করেছি সেখানে ক্রিপটো কারেন্সি বিট কয়েনে দুটি অ্যাকাউন্টের তথ্য পেয়েছি। যেখানে একটিতে দেড় কোটি ও আরেকটিতে ৮০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। এসব টাকাই তিনি পাচার করেছেন। তার আরও অ্যাকাউন্ট আমরা খুঁজছি। এজন্য ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা লাগবে।
চক্রের মাস্টারমাইন্ড দুই চীনা নাগরিককে খোঁজা হচ্ছে
এসপি ফারহানা বলেন: র্যাপিড ক্যাশ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ডিজিটাল লেনদেনে বৈধ প্রতিষ্ঠান নয় জানিয়ে তিনি বলেন, গুগলে অ্যাপসটি অ্যাভেইলেবল। এছাড়া ফেইসবুকেও বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশি গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুই চীনা নাগরিক সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। তারা নাকি দেশ ছেড়েছেন। সেটি সত্য কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি অ্যাপসটির ব্যবহার বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গুগল প্লে স্টোর থেকে যেন এমন প্রতারণামূলক অ্যাপস সরানো হয় সেজন্য অনুরোধ জানিয়ে গুগলকে মেইল করা হবে। এর প্রচার বন্ধে ফেসবুককেও জানানো হবে।