‘নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দিতে শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে গুরত্ব দেয়ার বিকল্প নেই’- দেশ স্বাধীনের পর এমন ভাবনার গুরুত্ব থাকলেও বাস্তবে এমন কথার প্রয়োগ ঠিক উল্টো, অন্তত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে! কেননা, বিজয়ের ৫২ বছরে বিভিন্ন জনরায় কয়েক হাজার সিনেমা নির্মাণ হলেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা সাকল্যে নির্মিত হয়েছে বড়জোর ষাট থেকে সত্তরটি!
মানে বছরে গড়ে ২টি সিনেমাও নির্মিত হয়নি। যদিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ নিয়ে সবসময় নানা প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে এসেছেন নির্মাতারা। বেশির ভাগই বলেছেন, যুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে যে বাজেট প্রয়োজন, তার বরাদ্দ নেই। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মত-বিভেদ মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরিতে অন্তরায় বলে মনে করেন।
তবে চলতি বছরে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক’ সিনেমা নির্মাণের সংখ্যাটি অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় বেশ আশাব্যঞ্জক! এ বছর বিভিন্ন জনরায় মোট ৫০টির মতো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, এরমধ্যে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০টির মতো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে- যেগুলো মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে নির্মিত!
সিনেমাগুলো হচ্ছে ওরা ৭ জন, জেকে ১৯৭১, মা, একটি না-বলা গল্প,রেডিও, মাইক, ফিরে দেখা,মৃত্যুঞ্জয়ী এবং ‘ফ্ল্যাশব্যাক ৭১’। এরমধ্যে ‘ফ্ল্যাশব্যাক ৭১’ সিনেমাটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে সরকারি অনুদান পেলেও সিনেমাটি ১৫ ডিসেম্বর পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে মুক্তি পেয়েছে।
এ বছর মুক্তি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে ‘১৯৭১ সেই সব দিন’। হৃদি হকের নির্মাণে সরকারি অনুদান পাওয়া এই সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে দাপটের সঙ্গে চলেছে। বিশেষ করে সিনেপ্লেক্সের দর্শকদের এই ছবিটি নিয়ে দেখা গেছে দারুণ কৌতূহল।
সাধারণ দর্শক থেকে চিত্রসমালোচক, সকলেই ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ এর নির্মাণ ও গল্প বলার উপস্থাপন পছন্দ করেছেন। সমালোচকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্টেরিওটাইপ গল্প বলার ভঙ্গি থেকে বের হয়ে হৃদি হক তার সিনেমায় নতুনত্ব দিয়েছেন বলেই দর্শক সিনেমাটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শুধু দেশেই নয়, সিনেমাটি দেশের বাইরেও হয়েছে প্রশংসিত!
হৃদি হকের পরেই এ বছর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত খিজির হায়াত খানের ‘ওরা ৭ জন’ সিনেমাটি হয়েছে দর্শক নন্দিত। তারকাবহুল সিনেমাটি চলতি বছরের মার্চে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়, তারআগে প্রদর্শীত হয়েছে দেশ বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবেও। পরিচালনার পাশাপাশি ছবিতে খিজির হায়াত অভিনয়ও করেছেন। শিগগির নির্মাতা ডিজিটাল প্লাটফর্মে মুক্তি দিবেন।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ভুবনমাঝি’র নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন খান চলতি বছরে আবারও নিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধনির্ভর ছবি। একটু বড় ক্যানভাসে নির্মিত এই ছবির নাম ‘জেকে ১৯৭১’। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে প্রথম ইংরেজি ভাষার বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। এতে প্রধান চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী ও শুভ্র সৌরভ দাস অভিনয় করেন।
আলোচনায় ছিলো মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর আরেক ছবি ‘মা’। নাটকের দাপুটে নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার সময়ের সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেন। ১৯৭১ সালে মৃত ঘোষণা করা সাত মাসের এক সন্তানকে নিয়ে তার অসহায় মায়ের গল্প উঠে এসেছে এই ছবিতে। ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে অনন্য মামুনের ছবি ‘রেডিও’ নিয়েও ছিলো দর্শকের কৌতুহল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার ক্ষেত্রে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত একটি গ্রামে রেডিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা নিয়ে এই চলচ্চিত্রের গল্প। ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন চিত্রনায়ক রিয়াজ ও জাকিয়া বারী মম।
এছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে শ্যাম বেনেগাল নির্মিত বছরের বহুল আলোচিত ‘মুজিব’ এর বড় অংশ জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ।