মুন্সিগঞ্জের কবির হোসেন ও গাইবান্ধার খাদিমুল ইসলাম সাইফুলের মতো অনেক তরুণ স্বপ্ন বুনছিলেন, এবছর প্রিয়তমাকে বধুবেশে নিজের ঘরে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না! প্রিয়তমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ভালো থেকো প্রিয়তমা, তোমাকে এবছরও ঘরে তুলতে পারছি না! কারণটা আর কিছু নয় বাজারে স্বর্ণের দাম।
বিয়ের বাধ্যতামূলক অনুসঙ্গ স্বর্ণালঙ্কার হলেও তার দাম এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। সেই স্বর্ণের ভরি এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম এক লাখ ৭৭৭ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে তরুণদের তাদের সঙ্গিনীদের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বার্তা দিতে দেখা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এ দাম বৃদ্ধির তথ্য জানায়। যা কার্যকর হয়েছে শুক্রবার থেকেই। নতুন দাম কার্যকরে জুয়েলারি গুলোতে ক্রেতাদের আনাগোনা কমেছে অনেক আংশে।
সঞ্চয় সামগ্রী হিসেবে বহুল ব্যবহৃত স্বর্ণের অধিক ব্যবহার আমরা দেখতে পাই সৌন্দর্য, আভিজাত্য প্রকাশের অনুসঙ্গ হিসেবে। এই ধাতব দ্রব্যর আকাশচুম্বী ব্যবসায় দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলছেন ব্যবসায়ীরা। তবে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগে। অনিবার্য প্রযোজনে অনেকেই স্বর্ণ কেনেন বলেই বাজারে হঠাৎই প্রভাব পড়ে না।
রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী নূরুল হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ স্বর্ণ কেনে না। আগে যেমন শখ করে অনেকেই স্বর্ণ কিনতো, এখন সেটা আর কেনে না। বিয়ের আচার অনুষ্ঠানের জন্যই শুধু স্বর্ণ কেনে। আগে যে ক্রেতা ১০ ভরি স্বর্ণ কিনতো এখন দেখা যাচ্ছে দু-তিন ভরির বেশি কিনছেন না। সৌখিনতার জন্য মানুষ খুব কম স্বর্ণ ব্যবহার করে। বড় ধরণের অলঙ্কার তো মানুষ এখন আর কেনে না। যারা আসে হালকা অলঙ্কার কেনে।
স্বর্ণের এমন মূল্যবৃদ্ধিতে আগামী দিনগুলোতে এই ব্যবসায় ঠিকে থাকতে পারবেন কিনা, এটা নিয়েই এখন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ছোট স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মাঝে।
দেশের বাজারে চলতি বছর অন্তত দশ দফা বেড়েছে ভালো মানের স্বর্ণের দাম। গতবছরের শেষ ভাগে ৮৮,৪১৩ টাকা ছিলো ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম। ১৮ মার্চ দেশের ইতিহাসে এক লাফে সব থেকে ভালো মানের স্বর্ণের দাম ভরিতে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বাড়ানো হয়। প্রতি ভরির দাম হয় ৯৮ হাজার ৭৯৪ টাকা। ১৯ মার্চ থেকে এ মূল্য কার্যকর হয়। এরপর দেশে স্বর্ণের দাম কয়েক দফা বাড়ানো ও কমানো হয়। এবার অতীতে সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ডে স্বর্ণের দামে।
এমন পরিস্থিতিতে স্বর্ণের ব্যবহার কমিয়েছেন ক্রেতারা। এমনই একজন ক্রেতা সাবিহা আক্তার। সামনে ছেলের বিয়ে, ছেলের বৌয়ের জন্য স্বর্ণ কিনতে এসেছেন। স্বর্ণের দামে বিষ্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন: ‘স্বর্ণের যে দাম শুনছি তাতো অবাস্তব, অবাক লাগছে। আমার তো মনে হয় আমাদের নেক্সট জেনারেশনের স্বর্ণ প্রতি ভরি ৫-৭ লাখ টাকা করে কিনতে হবে। নিজের কথা বলি আগে আমি হাতে-গলায় সব সময় অলঙ্কার পরতাম, এখন সেখানে কোন একটি পরি।’
স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল জানিয়েছেন: রাশিয়া সোনার উৎপাদনকারী বড় দেশ এবং যুদ্ধের জের ধরে কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার স্বর্ণ বাজারে আসছে না। হঠাৎ করে কাল যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো দাম কমতে পারে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার, ক্রুড ওয়েলের দামসহ আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা নিলে বলতে হয়, দাম কমার আপাতত কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না।
স্বর্ণের দাম বাড়লেও এর আবেদন কমে যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইজিং অ্যান্ড প্রাইজ মনিটরিংয়ের সদস্য বিমল চন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন: ‘যারা মোটামোটি ধরনের চাকুরি করেন, কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে স্বর্ণ উপহার হিসেবে দিতেন। কিন্তু এখন আট আনা স্বর্ণের দামই পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগে। তাই এখন তারা ৫-১০ হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখানে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ে। প্রতিদিনই এ দাম ওঠা-নামা করে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে অটোমেটিক দাম বেড়ে যায়।’
স্বর্ণের এতো দামের কারণ কী?
স্বর্ণের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি’ আর ‘অকার্যকর আমদানি নীতি’র কারণেই স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে, যা কমার লক্ষণ খুব একটা নেই। বৈশ্বিক পরিস্থিতি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও এতো দাম হওয়া উচিত নয়। বরং স্বর্ণের যথাযথ বাজার মেকানিজম না থাকাকেই দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার জন্য দায়ি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদের হার বৃদ্ধি এবং মন্দার আশঙ্কার কারণে বিশ্ব বাজার অনিশ্চিত হয়ে পড়ার কারণে সোনার দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছিলেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
তারা বলছেন: বিশ্বের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি ধারণার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর ব্যাংকগুলো সোনাতেই বেশি বিনিয়োগ করছিলো। একই সাথে ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়াও সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ি।আবার অন্য বৈশ্বিক মুদ্রার সাথে ডলারের দাম কমে গেলেও সোনার দাম বেড়েছে।
অনেক বিশ্লেষক অবশ্য কোভিড মহামারির পর আবার যুদ্ধ পরিস্থিতি ও চীনের অর্থনীতির গতি ধীর হওয়াকেও সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন।