বিজয় অনেক রূপে আসে। কখনও নিয়মিতই পাওয়া যায় এর দেখা, কখনও করতে হয় দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তিকর অপেক্ষা। ৩৩ বছর পর একবিংশ শতাব্দীতে প্রথমবার সিরি আ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দটা তাই নাপোলির জন্য বিশেষ এক উৎসবের উপলক্ষ হয়ে এসেছে।
ট্রফি জয়ের স্বাদ ভুলতে বসা দলটির শিরোপা জয়ের পথে রয়েছে বেদনার ইতিহাস। অস্তিত্ব বিলীন হতে বসার যন্ত্রণা ইতালিয়ান ক্লাবটিকে সহ্য করতে হয়েছিল।
উদিনেসের বিপক্ষে ম্যাচে রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর শেষ হয় নেপলসের মানুষের তিন দশকেরও বেশি সময়ের প্রতীক্ষা। খেলা শেষে উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় নেপলস। রাস্তায় নেমে উচ্ছ্বসিত সমর্থকরা আতশবাজি ফোটাতে থাকে।
১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি এপর্যন্ত তিনবার সিরি আ, ছয়বার কোপা ইতালিয়া, দুবার সুপারকোপা ইতালিয়ানা এবং একবার ইউরোপা লিগ জিতেছে। অথচ ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি একসময় হয়েছিল দেউলিয়া।
আর্থিক সংকটে জর্জরিত নাপোলিকে ২০০৪ সালে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে অরেলিও ডি লরেন্তিস ক্লাবটি কিনে নেয়ার পর শুরু হয় পুনর্গঠন। ইতালির তৃতীয় বিভাগে অংশ নিয়ে তাদের পুনরায় শুরু হওয়া পথচলাটা মসৃণ ছিল না। ২০০৬-০৭ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগে উঠে এসে, পরের মৌসুমে আবারও সিরি আ খেলতে নামে নাপোলি।
লরেন্তিস মোটেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। ১৯ বছর ধরে ক্লাবের দায়িত্বে থাকা মানুষটি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করেছিলেন, শিরোপা একদিন ধরা দেবেই। ক্লাব কিনে নেয়ার ১৯ বছর পর হয়েছে তার অপেক্ষার অবসান।
উদিনেসের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে পাঁচ ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নাপোলি। লিগের খেলাটি উদিনেসের মাঠে হলেও বিশেষ মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে ৫০ হাজারেরও বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নাপোলির হোম গ্রাউন্ড নেপলসের স্টাডিও ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনায় জায়ান্টস্ক্রিনে ম্যাচ দেখানো হয়।
ম্যাচ শেষে স্টাডিও ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনায় উপস্থিত নেপলসের মেয়র গাইতানো মানফ্রেডিকে জড়িয়ে ধরে ক্লাব সভাপতি লরেন্তিস বলতে থাকেন, ‘‘আপনি আমাকে সবসময় বলেছিলেন, ‘আমরা জিততে চাই।’ এখন আমরা জিতেছি। আমরা সবাই একসাথে জিতেছি।’’
৩৩ বছর পর ইতালিয়ান লিগ জয়ের তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে নাপোলির কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি বলেছেন, ‘নাপোলি, এই শিরোপা আপনাদের জন্য। এখানে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা তাদের জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন, কারণ তারা এই মুহূর্তটিকে মনে রাখবেন। কঠিন সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষরা সকল আনন্দে মেতে ওঠার যোগ্যতা রাখেন।’
ম্যাচের ১৩ মিনিটে গোল হজম করে পিছিয়ে পড়েছিল নাপোলি। ডানপায়ের শটে স্বাগতিকদের এগিয়ে দেন সানসি লোভরিচ।
বিরতির পর ৫২ মিনিটে কর্নার কিক থেকে উড়ে আসা বলে ডান পায়ের কিকে নিশানাভেদ করেন ভিক্টর ওসিমহেন। সিরি আ’র চলতি মৌসুমে এপর্যন্ত সর্বাধিক গোলদাতা বল জালে জড়াতেই আগাম ট্রফি জয়ের উৎসব শুরু করে স্টেডিয়ামের ভেতর-বাইরে থাকা নাপোলির সমর্থকরা।
নিজের করা গোল নয়, ওসিমহেন ম্যাচ শেষে চ্যাম্পিয়ন হওয়াকেই সবচেয়ে বড় করে দেখছেন। বলেছেন, ‘আমি বিশ্বব্যাপী সমস্ত নাপোলি ভক্তদের জন্য আনন্দিত। কে গোল করেছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা ইতালিয়ান ক্লাবটিতে খেলার সময় ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে শিরোপা জিতিয়েছিলেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর তার নামেই ক্লাবের স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়। সিরি আ জয়ের উৎসবের মাঝে ম্যারাডোনাকে হারানোর হাহাকারও ছিল সবার মাঝে।
নাপোলির কোচ স্পালেত্তি আবেগাক্রান্ত হয়ে বলেছেন, ‘এই সাফল্যের মাঝে ম্যারাডোনার প্রভাব অনুভূত হয়েছে।’ তবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দলের আবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পরপারে থাকা আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির আত্মা হয়তো প্রশান্তি পাচ্ছে।