হাবিবুর রহমান হেলাল, জার্মানি প্রতিনিধি: শিক্ষা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য জার্মানির সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ও পদার্থবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম আবু জাকারিয়া।
শুক্রবার ২২ মার্চ জার্মানির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা “বুন্ডেজফারডিনস্টঅরডেন্স” বা “ফেডারেল ক্রস অব মেরিট” এ ভূষিত হলেন জার্মানির নর্দরাইন ভেস্টফালেন নিবাসী এই বাংলাদেশি। অঙ্গরাজ্যটির ভিহল শহরের বুর্গহাউস বিলস্টাইনে একটি মিলনায়তনে তার হাতে এই সর্বেচ্চ সম্মাননা তুলে দেন রাজ্যটির ওবারবের্গ অঞ্চলের উপদেষ্টা ইয়োখেন হাগট ও নগরীর মেয়র উলরিখ স্টুইকার।
জার্মান সরকারের এমন সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পেয়ে ড. জাকারিয়া বলেন, এই সম্মাননা আমার গবেষণা ও কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেবে। আমি বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত ও আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, পদার্থবিজ্ঞান ও ক্যান্সার নির্মূল নিয়ে দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গবেষণায় অবদান রাখার পাশাপাশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কয়েক’শ ছাত্রছাত্রী তার দেখানো পথ অনুসরণ করে সফল হয়েছে।
বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার ইকরকুড়ি গ্রামে জন্ম নেয়া ৭০ বছর বয়সী ড. জাকারিয়া উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি হোন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে জার্মানিতে যান ড. জাকারিয়া। শুরুতে স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয় নিয়ে পড়াশোনার কথা থাকলেও পদার্থ ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
শুরুর দিকে আনহাল্ট ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সাইয়েন্সের ক্লিনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা করেন তিনি। এরপর কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুইমারসবাখ টিচিং হাসপাতালের মেডিকেল ফিজিক্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ড. জাকারিয়া।
মরণব্যাধি ক্যানসার চিকিৎসায় মেডিকেল ফিজিসিস্টের গুরুত্বটা আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ড. জাকারিয়া। তিনি বলেন, ‘যেখানে মেডিসিন আছে, সেখানেই আমরা এই সায়েন্সকে ব্যবহার করতে পারি। মূলত রেডিয়েশন যেখানে ব্যবহার করা হয়, আজকের জগতে সেখানেই এটির ব্যবহার রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, একজন ডাক্তার ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করবেন। তার জন্য তিনটি মোডালিটি আছে: সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। যখন রেডিওথেরাপি করবে, সেটি রেডিয়েশন দিয়ে। কিন্তু রেডিয়েশন তো দেখা যায় না, শোনা যায় না, এর স্বাদ নেই। কিন্তু সেটা আমরা শরীরে ব্যবহার করছি। শরীরে যেখানে ক্যানসার সেখানে যদি এটি দিতে পারি, তাহলে ক্যানসার আরোগ্য হবে। কিন্তু যেখানে ক্যানসার নেই, সেখানে যদি এটা পরে, তাহলে কিন্তু আবার ক্যানসার হবে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার না? সেজন্য আমাদেরকে এমনভাবে দিতে হবে, যেখানে ক্যানসার সেখানেই এবং আশেপাশের সব কোষগুলোকে বাঁচাতে হবে।’
আর এ কাজটি মেডিকেল ফিজিসিস্টরাই করতে পারেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কারণ চিকিৎসকেরা জানাবেন, এই স্থানে ক্যানসার, আমি সেখানে রেডিয়েশন দিতে চাই। যেখানে ক্যানসার আক্রান্ত অংশ রয়েছে শুধু সেখানেই সেটি কার্যকর হবে। এজন্য প্রচুর অ্যালগরিদম রয়েছে। বিজ্ঞানের অনেক ব্যবহার আছে। কম্পিউটারের সাহায্যে আমরা কাঙ্ক্ষিত স্থানে রেডিয়েশন পৌঁছাতে পারি।’
আর এটাকেই চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার অন্যতম বিশেষত্ব হিসেবে মনে করেন তিনি। অধ্যাপক জাকারিয়া বলেন, জার্মানিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ তার অধীনে এই চিকিৎসা নিয়েছেন। বিজ্ঞানের একজন মানুষ হয়ে এতো রোগীকে সুস্থ করে তোলা তার জন্য বিরাট ব্যাপার বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেডিকেল ফিজিক্স নিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মাস্টার্সে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি করেন তিনি। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়ারও সুযোগ তৈরি করেন আবু জাকারিয়া। দেশের যেসব হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়, প্রায় সবখানেই তার হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা রয়েছেন বলে জানান তিনি।
এছাড়া নানা সময়ে দূরারাগ্য ব্যাধি ক্যানসার চিকিৎসায় অসামান্য অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সম্মাননা গ্রহণ করেন ড. জাকারিয়া। আমৃত্যু বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও বেশি অবদান রাখতে চান বলেও জানান গুণী এই বাংলাদেশি। গবেষণা ও অধ্যাপনার পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বেশ কয়েকটা বই লেখা ও সম্পাদনা করেন ড. আবু জাকারিয়া।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির মধ্যে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই ছিলেন উপস্থিত।