বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বাচসাসের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠনটি কাজ করছে সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র অভিনেতা-কলাকুশলীদের জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রচলন হয় এই সংগঠনটির হাত ধরেই। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী সাহসীকতায় যে বাঘের পরিচয় দিয়েছে সেই জাতীয় প্রতীক বাঘকে করা হয়েছে পুরস্কারের প্রতীক।
১৯৭৪ সাল থেকে এই সংগঠনটি শুরু করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি-বাচসাস পুরস্কার প্রদান। ১৯৭২-৭৩ সালের চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরা অবদানের জন্য প্রথম পুরস্কার আসর বসে। এই আয়োজনে ১৫টি বিভাগে ১৭ জন বিজয়ীকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রথম বাচসাস পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাটি। শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার লাভ করে জহির রায়হানের বিশ্ব আলোড়ন জাগানো তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’।
এছাড়াও সেই আয়োজনে ‘তিতাস একটি নদীর নাম; ও ‘লালন ফকির’ যৌথভাবে সর্বোচ্চ চারটি পুরস্কার লাভ করে। তখন থেকেই সেরা চলচ্চিত্র, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা, পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, পুরুষ কণ্ঠশিল্পী, নারী কণ্ঠশিল্পী, কাহিনীকার, চিত্রনাট্য, সংলাপ, চিত্রগ্রাহক, শিল্প নির্দেশক, সম্পাদনার জন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এই সংগঠনটির সাথে জড়িত ছিলেন/ আছেন ‘ডেইলি অবজারভার’ সম্পাদক ওবায়েদ উল হক, কবি ও সাংবাদিক ফজল শাহাবুদ্দিন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শাহাদাৎ চৌধুরী, আজিজ মিসির, চিত্রালী সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক রফিকুজ্জামান, সাংবাদিক হীরেন দে, চলচ্চিত্র সাংবাদিক আবদুর রহমান, চিন্ময় মৎসুদ্দী, অনুপম হায়াত, আরেফিন বাদল, শহীদুল হক খান, হাসান হাফিজ, নরেশ ভূইয়া, শফিউজ্জামান খান লোদী, আনন্দ আলো সম্পাদক রেজানুর রহমান, অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান, সাংবাদিক নেতা সোহেল হায়দার চৌধুরী, আবু জাফর সূর্য, প্রমুখ।
এছাড়াও টেলিফিল্ম, টিভি সিরিয়াল, টিভি নাটক, টিভি অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপনচিত্র, মঞ্চ নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা জুরি বোর্ড নির্বাচন করে। সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সাধারনত জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। জুড়ি বোর্ডে নির্বাচিতরা পান পুরস্কার। শুরু হওয়া সে পথচলায় কিছুটা বিরতি আসে মাঝপথে। ১৯৮৮ সালের পর টানা ৭ বছর বন্ধ ছিলো দেশের চলচ্চিত্র জগতের সর্বপ্রথম প্রবর্তিত এই পুরস্কার। ১৯৯৫ সাল থেকে আবার নিয়মিতভাবে বাচসাস পুরস্কার প্রদান শুরু হয়।
শেষবার বাচসাস পুরস্কারের ৪০ তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে ২হাজার ১৯ সালের ৬ নভেম্বর। সংগঠনটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৪ থেকে ১৮ পাঁচ বছরের পুরস্কার প্রদান করতে সংগঠনটি আয়োজন করে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত ফিল্ম আর্কাইভ ভবন মিলনায়তনে চলচ্চিত্রের শিল্পী ও কলাকুশলীদের পাঁচ বছরে পাওনা পুরস্কার প্রদান করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)।
এই আয়োজনে দিনব্যাপী ছিল সেমিনার, প্রীতি বিতর্ক, পোস্টার প্রদর্শনী ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। সন্ধ্যায় নায়ক-নায়িকা, পরিচালক ও কলাকুশলীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি ছিল সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সভাপতিত্ব করেন বাচসাসের তৎকালীন সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুর রহমান।
অনুষ্ঠানে অংশ নেন শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, সিয়াম, পূজাসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, আঁখি আলমগীর প্রমুখ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন আনজাম মাসুদ, দেবাশীষ বিশ্বাস, সৈকত সালাহউদ্দিন ও শান্তা জাহান।
বাচসাসের সুবর্ণজয়ন্তীর আসরে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় চিত্র নায়ক আলমগীরকে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট পাঁচ ব্যক্তিত্বকে দেওয়া হয় বিশেষ ইমেরিটাস অ্যাওয়ার্ড। তাঁরা হলেন সৈয়দ হাসান ইমাম (অভিনয় ও নির্মাণ), কোহিনুর আখতার সুচন্দা (অভিনয়), সাবিনা ইয়াসমিন (সংগীত), মীর্জা আবদুল খালেক (প্রদর্শক) ও ফরিদুর রেজা সাগর (প্রযোজক)।
একনজরে বাচসাস পুরস্কার ২০১৪-২০১৮
আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন চিত্রনায়ক আলমগীর, ইমেরিটাস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, শিশু সাহিত্যিক, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আই’র ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, বরেণ্য অভিনেতা ও পরিচালক সৈয়দ হাসান ইমাম, অভিনেত্রী ও পরিচালক কোহিনুর আখতার সুচন্দা, সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন ও মীর্জা আবদুল খালেক।
বাচসাস পুরস্কার ২০১৪ পেয়েছেন
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: দেশা: দ্য লিডার, শ্রেষ্ঠ পরিচালক: সৈকত নাসির (দেশা: দ্য লিডার) , শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক: আহম্মেদ হুমায়ূন (স্বপ্ন ছোঁয়া), শ্রেষ্ঠ গায়ক: বেলাল খান (অল্প অল্প প্রেমের গল্প) শ্রেষ্ঠ গায়িকা: লেমিস (অগ্নি), শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগ্রাহক: চন্দন রায় চৌধুরী (দেশা: দ্য লিডার), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পার্শ্বচরিত্রে): তারিক আনাম খান (দেশা: দ্য লিডার), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: ফেরদৌস (এক কাপ চা), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: মাহিয়া মাহি ( দেশা: দ্য লিডার)।
বাচসাস পুরস্কার ২০১৫ পেয়েছেন
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: পদ্মপাতার জল, শ্রেষ্ঠ পরিচালক: মোরশেদুল ইসলাম (অনিল বাগচীর একদিন), শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক: শওকত আলী ইমন (ব্ল্যাকমানি), শ্রেষ্ঠ গায়ক: আসিফ আকবর (পদ্মপাতার জল), শ্রেষ্ঠ গায়িকা: এলিটা করিম (পদ্মপাতার জল), শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগ্রাহক: মাহফুজুর রহমান খান (পদ্মপাতার জল), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পার্শ্বচরিত্রে): সাদেক বাচ্চু (লাভ ম্যারেজ), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্বচরিত্রে): জ্যোতিকা জ্যোতি (অনিল বাগচীর একদিন),শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: আরিফিন শুভ (ছুঁয়ে দিলে মন), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: বিদ্যা সিনহা মিম (পদ্মপাতার জল)।
বাচসাস পুরস্কার ২০১৬ জিতেছেন
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: অজ্ঞাতনামা, শ্রেষ্ঠ পরিচালক: তৌকীর আহমেদ (অজ্ঞাতনামা), শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক: পিন্টু ঘোষ (অজ্ঞাতনামা),শ্রেষ্ঠ গায়িকা: সিঁথি সাহা (ভোলা যায় না তারে), শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগ্রাহক: রাশেদ জামান (আয়নাবাজি), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পার্শ্বচরিত্রে): ফজলুর রহমান বাবু (অজ্ঞাতনামা), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্বচরিত্রে): মৌসুমী হামিদ (পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী ২),শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: চঞ্চল চৌধুরী (আয়নাবাজি)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: নাবিলা (আয়নাবাজি), জুরিবোর্ডের বিশেষ পুরস্কার: কুমার বিশ্বজিৎ।
বাচসাস পুরস্কার ২০১৭ প্রাপ্তরা হলেন
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: রাজনীতি, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: ঢাকা অ্যাটাক, শ্রেষ্ঠ পরিচালক: হাসিবুর রেজা কল্লোল (সত্তা), শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক: বাপ্পা মজুমদার (সত্তা), শ্রেষ্ঠ গায়ক: জেমস (সত্তা), শ্রেষ্ঠ গায়িকা: মমতাজ (সত্তা), শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগ্রাহক: আসাদুজ্জামান মজনু (রাজনীতি), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পার্শ্বচরিত্রে): আনিসুর রহমান মিলন (রাজনীতি), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্বচরিত্রে): রুনা খান (হালদা)। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্বচরিত্রে): নাসরিন (সত্তা), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: শাকিব খান (সত্তা), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: তিশা (হালদা), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: অপু বিশ্বাস (রাজনীতি)
বাচসাস পুরস্কার ২০১৮ প্রাপ্তরা হলেন
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র: দেবী, শ্রেষ্ঠ পরিচালক: অনম বিশ্বাস (দেবী), শ্রেষ্ঠ গায়ক: ইমরান (নায়ক), শ্রেষ্ঠ গায়িকা: আঁখি আলমগীর (একটি সিনেমার গল্প), শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগ্রাহক: সাইফুল শাহীন (পোড়ামন ২), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পার্শ্বচরিত্রে): মিশা সওদাগর (জান্নাত)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্বচরিত্রে): শবনম ফারিয়া (দেবী), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: সিয়াম (দহন)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: জয়া আহসান (দেবী),জুরিবোর্ডের বিশেষ পুরস্কার: পূজা চেরী (নবাগত নায়িকা)।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি -বাচসাসের নতুন মেয়াদে সভাপতি নির্বাচিত হন কবি, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক রাজু আলীম। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সাংবাদিক রিমন মাহফুজ।
সংগঠনটির নতুন সভাপতি রাজু আলিম জানান, ৫৪ বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী সংঘঠনটিকে নতুন যুগের সাথে এগিয়ে নিয়ে সব ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে এগিয়ে যাবার চিন্তা করছে বাচসাস। শুধু বাচসাস পুরস্কারই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন আয়োজনে দেশের সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কাজ করবে বাচসাস।
এছাড়াও ওটিটি প্লাটফর্ম, ডিজিটাল কন্টেন্টসহ সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রের নানা ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বৈশ্বিকভাবে উন্মুক্ত হয়েছে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা করছে বাচসাস। আগামীতে বাচসাসের উদ্যেগে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যাল আয়োজনসহ শিল্পী, কলাকুশলী ও সাংবাদিকদেও পেশাগত উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে বাচসাস। সব ক্ষেত্রে নিয়েও বাচচাসের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এই চলচ্চিত্র সাংবাদিক।