জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিষয়টি বৈশ্বিকভাবে ঘটে যাওয়া অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মতো নয়।
বিগত ৫০ বছরের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও তার কাঠামোগত ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। অর্থাৎ অন্যান্য সকল হত্যাকাণ্ডগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা রাজনৈতিক হিসেব, নিকেশের হলেও এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছিল একটি আদর্শকে চাপা দেয়ার জন্য। বিস্তৃত অর্থে, এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে একেবারে শেষ করে দেবার ভিশন।
এই চিন্তার পক্ষে যুক্তি হল, ঘাতকদল বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলকেও ছাড়েনি। বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক বাতি ধরবার জন্য তার শেষ উত্তরাধিকার বা প্রদীপটিকেও নিভিয়ে ফেলা। বঙ্গবন্ধু কন্যাদের বিষয়টি হয়ত তারা ভিন্নভাবে নিয়েছিলেন। কারণ বাঙালি নারীরা তখনো বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এজন্য অবশ্যই বাংলার জনগণ বাহবা পাবেন। তারা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনায় আস্থা রেখে সেই তিমির অচলাবস্থা পাড়ি দিয়েছেন।
বাঙালির শান্ত সাহস শেখ হাসিনাও সেই ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সচারচর সমাজ সংস্কৃতিতে দেখা যায়, একজন আরেকজনের দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলে কখনো সুযোগ পেলে কোন আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে তার প্রতিশোধ তুলে বসেন। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা ধৈর্যের সেই অসীম সুধা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকেও পিতা-মাতাসহ সপরিবারে হত্যার বিচার স্বাভাবিক নিয়মে, একজন সাধারণ জনগণের মত সম্পন্ন করেছেন। এসবই ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণস্বরূপ এবং দলিল হয়ে থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই প্রজন্মের আরেক আগ্রহ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রের গভীরতা ও এর সাথে যুক্ত শেষ নেপথ্য কুশীলব সম্পর্কে জানা। কারণ এটা পরিষ্কার এই পরিকল্পনা কয়েক মুহূর্তের নয়। কাজেই এই প্রক্রিয়া ঠিক কবে থেকে শুরু এবং এর ফসল কাদের কাদের ঘরে গেছে সেই তালিকা জানা প্রয়োজন। ভিনদেশী ষড়যন্ত্র নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ এটা মোটামুটি স্পষ্ট এবং তাদের নির্লজ্জের ইতিহাস বহু পুরনো। তাছাড়া চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব নয় তাদের প্রাধান্য পায় চিরস্থায়ী স্বার্থ। কাজেই হেরে যাবার বা পক্ষপাতিত্ব করবার পরাজয় তাদের পোড়াবে সেটাই স্বাভাবিক।
১৫ আগস্ট দিনটিতে বাংলার জমিন, ফুল, পাখি কাঁদে। অন্যদিকে তৎকালীন বিশ্বাসঘাতকতা ও সুবিধাবাদীদের বেহায়াপনাকে আরও স্পষ্ট করে। সাথে অন্যদের লোভের সীমানায় নিয়ন্ত্রণের তাগিদ যোগায়। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক উন্নয়নের অংশীদার। কাজেই একে নিয়ে এখন আগের চেয়েও অন্যদের আগ্রহ বেশি। ভরসার জায়গা এই যে নেতৃত্বে আছেন শেখ হাসিনা।
এখন প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর সেই দর্শন চিন্তাকে পরিপূর্ণভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মত চাপা অরাজকতাকে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুর এমন অনমনীয় চিন্তা, দর্শনের কারণেই ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলা দেশে যা আবারো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আরো দীর্ঘ এরিয়া আছে। তা হল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কারণেই গোটা এশিয়া প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রমঞ্চ হওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে। নইলে প্রতিবেশী তিনটি দেশের সীমানায়ই গোলমেল লেগে থাকত। দীর্ঘ দূরত্বের পাকিস্তান এবং প্রতিবেশী ভারত উভয়েই অস্থির সময় পার করত। বিস্তৃত অর্থে, পেছন থেকে অন্য শক্তি এসে যুদ্ধ আরো উসকে দিত। এতে তাদের মিলত অস্ত্রের বাজার।
এমনটা হলে আজকে এশিয়ার দেশগুলোর যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তা লাটেই উঠে থাকত, ধরা দিত না। একারণেই বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন, সীমানার বাইরেও ভাস্কর। যদিও সেখানেও গোলমেল করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাকে অস্বীকার করে অন্য একজনকে তার সমকক্ষ করবার পাঁয়তারা হয়েছে। মূর্খের মত ভুলভাল জন্মদিন পালন করতে দেখা গেছে। এসবই মানসিক দৈন্যতার ফল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘসুত্রতার ফসল। কাজেই একে সমূলে উৎপাটন করতে একে নিয়ে আরো জোরালো পরিধি প্রয়োজন। এই ষড়যন্ত্রের সূত্রতা বের করে সকলকে আইনের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এটা করতে পারলে হত্যা, ষড়যন্ত্র এবং নৈরাজ্যের রাজনীতি বন্ধ হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)