কোন চিকিৎসক’ই রোগীর মৃত্য চায় না, তবে এখানে আয়ানের ক্ষেত্রে অবহেলা দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেখে সোমবার এই মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। শুরুতে রাষ্ট্র পক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদালতে পড়ে শুনান।
একপর্যায়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘কোন চিকিৎসক’ই রোগীর মৃত্য চায় না, তবে এখানে আয়ানের ক্ষেত্রে (নেগলিজেন্স) অবহেলা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটির অ্যাজমা জেনেও অপারেশনের সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হলো?’
অন্যদিকে, শিশু আয়ানের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধের তথ্য দেখে হাইকোর্ট বলেন, ‘বাইপাস সার্জারিতেও এতো ওষুধ লাগে না। এখানে শিশুটিকে যত ওষুধ দেয়া হয়েছে!’
শুনানির একপর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্টকে ‘লোক দেখানো ও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। সেই সাথে চিকিৎসকদের একটা ডিসিপ্লিনে চলা উচিত উল্লেখ করে হাইকোর্ট ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ বিষয়ে একটি টিম বা বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
শিশু আয়ানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে “মেনুপুলেটেড” উল্লেখ করে এঘটনায় পুনরায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চান রিটের পক্ষের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। এরপর আদালত এবিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারী দিন ধার্য করেন। আদালতে ইউনাইটেড হসপিটালের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কুমার দেবুল দে।
গত ৩১ ডিসেম্বর সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করানোর জন্য আনা হয় আয়ানকে। সেদিন সকাল ৯টায় খৎনা করার জন্য তাকে অজ্ঞান করা হয়। বেলা ১১টায়ও জ্ঞান না ফিরলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফসাপোর্টে রাখা হয় আয়ানকে। রোববার রাতে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
আয়ানের পরিবারের অভিযোগ, আংশিক অচেতন করে খৎনা করানোর কথা থাকলেও চিকিৎসকরা আয়ানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেছিল। অন্যদিকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়ানের যে মৃত্যুসনদ দেয় তাতে বলা হয়, আয়ানের মৃত্যুর কারণ কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
আয়ানের মর্মান্তিক এই মৃত্যুর ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জনস্বার্থে রিট করেন। সে রিটে শিশু আয়ানের চিকিৎসায় যুক্ত থাকা চিকিৎসকদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তাদের ডাক্তারি সনদ বাতিল ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সেই সাথে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলেন। সে অনুযায়ী ১৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়।যেখানে বলা হয়, আয়ানের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা (হাঁপানি) ছিল। সুন্নতে খৎনার অপারেশনের আগে ওয়েটিং রুমে তাকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়নি। তবে আইনজীবী আজ হাইকোর্টকে বলেছেন যে, আয়ানের অ্যাজমার বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়েছিল।
অন্যদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রোপচারের আগে আয়ানকে অ্যানেস্থেসিয়া বা সংবেদনহীন করতে প্রয়োগ করা ইনজেকশন প্রোফোফল মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাকটয়েড রিয়্যাকশন) সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে শ্বাসতন্ত্র সংকুচিত হয়ে (ল্যারিঙ্গো স্পাজম) বা (ব্রঙ্কোস্পাজম) শ্বাসনালীর আশপাশের পেশি শক্ত হয়ে খিঁচুনি হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) ও ওষুধ (মেডিকেশন) দিয়ে আয়ানের হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনতে ১০ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। যার কারণে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি (মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে মৃত্যু) হয়ে আয়ানের মৃত্যু হতে পারে। তবে রিটের পক্ষের আইনজীবী শিশু আয়ানের পাজড়ের হাড় ভেঙে ফেলার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন।