আজ রাত ১ টায় অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালের যুদ্ধ। মুখোমুখি আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়া। কাতারের লুসেইল স্টেডিয়াম প্রস্তুত। দুদলের সামনেই ফাইনালে খেলার অপূর্ব এক হাতছানি। নিশ্চিত মাঠে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে কথা বলবে না।
দুদলই জয়ের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে। দুদলেরই কিন্তু এতদূর উঠে আসার লড়াইয়ের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই উঠে আসতে হয়েছে। আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হারলেও পরবর্তী ম্যাচগুলোতে ভালো পারফর্ম করেই উঠে এসেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে আগুনঝরা ঘটনাবহুল ম্যাচে তারা হারিয়েছে নেদারল্যান্ডসকে। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়া বিশ্বের কোটি কোটি ব্রাজিল সমর্থকদের চোখের জলে ভাসিয়ে উঠে এসেছে সেমিফাইনালে। দুদলেরই আত্মবিশ্বাস, লক্ষ্য তাই মহাতুঙ্গে।
জয়ের জন্য দুদলই বহুবিধ কৌশল এঁটে বসে আছে। খেলা শুরু হওয়ার পরপরই সেইসব কৌশলের প্রয়োগ দেখা যাবে। তবে ম্যাচের আগেই বলে নেওয়া ভালো আর্জেন্টিনার লেফট ব্যাক মার্কোস অ্যাকুনা এবং রাইট ব্যাক পজিশনের গঞ্জালো মন্টিয়েল আজ খেলতে পারছেন না। বিকল্প হিসেবে থাকবেন তাগলিয়াফিকো, লিসান্দ্রো মার্টিনেজ।
ক্রোয়েশিয়াতে অবশ্য চোট বা কার্ডের মতো এসব সমস্যা নেই। সপ্রতিভ আছেন মদ্রিচ থেকে ব্রোজোভিচ, পেরিসিচ, পাসালিচ, ক্রামারিচ থেকে লিভাকোভিচ। কারো কোনো সমস্যা নেই। বরং ব্রাজিলকে হারানোর অনুপ্রেরণায় তারা অনুপ্রাণিত।

আজকের এই মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জয় পাওয়ার সমান অধিকার আছে দুদলেই। স্নায়ুর যুদ্ধ, মাঠের লড়াই, কোচের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত— সবমিলিয়ে শেষ মিনিট পর্যন্ত চলবে রুদ্ধশ্বাস। এরপর ফয়সালা হবে সবকিছুর। তবে যথারীতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি এবং ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদ্রিচ। এ দুজনকে ঘিরে চলছে রাজ্যের হিসেব-নিকেশ। লিওনেল মেসি ভালো ফর্মে রয়েছেন। পুরো দলকে নেতৃত্ব দিয়ে কার্যকর রেখে ফলাফল বের করতে তিনি অনন্য ভূমিকা রাখছেন।
একইভাবে ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদ্রিচও তাই। ৩৭ বছর বয়সেও মাঠজুড়ে তার অনবদ্য খেলার জুড়ি মেলানো ভার। অসম্ভব প্রাণশক্তি তার। ক্রোয়েশিয়াও সর্বাত্মক চেষ্টা করবে আজ জয়ী হয়ে গত বিশ্বকাপের ধারাবাহিকতা পুনঃস্থাপিত করতে।
আর্জেন্টিনা আজ হেরে গেলে বিশ্বকাপ ফাইনালের আভিজাত্য নিশ্চিত খানিকটা ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। আর আর্জেন্টিনা জয়ী হলে দুনিয়াজুড়ে বিশ্বকাপের উন্মাদনার তীব্রতা আরও বাড়বে। আজকের ম্যাচে কে জিতবে? এসব নিয়ে কথা হয় আশির দশকের দর্শকনন্দিত তারকা ফুটবলার, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত আশীষ ভদ্রের সাথে।
মধ্যমাঠের এই সাবেক তারকার খেলা এখনও ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মধুরতম স্মৃতি। আশীষ ভদ্র তৎকালীন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের (বর্তমানে আবাহনী লি.) হয়ে ঘরোয়া লিগে সবচেয়ে বেশিদিন খেলেন। এখনও তাই ‘আবাহনীর আশীষ’ বলেই তিনি স্বীকৃত। জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন অনেক অনেক দিন। চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার।
আজকের ম্যাচ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে শুরুতেই আশীষ ভদ্র বলেন, ‘আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়ার মধ্যেকার আজকের ম্যাচ হবে খুবই প্রাণবন্ত, দৃষ্টিনন্দন, উত্তেজনাময় এবং শ্বাসরুদ্ধকর। প্রতিটিক্ষণ দুর্দান্ত এক লড়াই হবে। ঘড়ির কাটা ধরে হিসেব নিকেশ চলবে। কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। লড়াই হবে মাঠে এবং একইসাথে ডাগআউটে। চলবে জোনাল মার্কিং থেকে প্লেয়ার টু প্লেয়ারের মার্কিং সমীকরণের লড়াই। তবে এই লড়াই-এ মেসি স্বরূপে জ্বলে উঠতে পারলেই আর্জেন্টিনার জয়ের সম্ভাবনা থাকবে সবচেয়ে বেশি।’
তিনি বলেন, ‘এই ম্যাচ কোনোভাবেই আর্জেন্টিনার জন্য সামান্যতম সহজ নয়। খুবই টাফ একটি ম্যাচ হবে, কেননা ক্রোয়েশিয়া বিধ্বংসী, বেপরোয়া। কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য ভীষণ ভরসার জায়গা একজন লিওনেল মেসি। সে এক্সেপশনাল এবং ফ্যান্টাস্টিক ফুটবল খেলছে। তার পারফরমেন্স এই ম্যাচের অনেককিছুই নির্ণয়ে ভূমিকা রাখবে। মেসিই হবে আজকের ম্যাচের নির্ণায়ক। মেসি জ্বলে উঠলেই আর্জেন্টিনা জ্বলে উঠবে।’
তবে আশীষ ভদ্র কোনোভাবেই ক্রোয়েশিয়াকে সামান্যতম খাটো করে দেখতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার খেলার ধরণটা কিন্তু আলাদা। ট্যাকটিক্যালি খুবই স্ট্রং। ওয়ান টু ওয়ান মার্কিং এর চেয়ে স্পেসব্লক করে খেলা তাদের একটা অন্যতম কৌশল। জোনাল মার্কিং-এর বিষয়টি তারা বেশি গুরুত্ব দেয়। এ ছাড়া ওদের ডিফেন্স খুবই ডিসিপ্লিন। এয়ার অ্যাটাকেও ওরা অনেক ভালো।’
ক্রোয়েশিয়া ও ব্রাজিলের মধ্যকার ম্যাচের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ঐদিন ক্রোয়েশিয়া যেভাবে খেলেছে, আজকেও মনে হয় সেভাবে খেলবে। শুধু মেসিকে আটকানোর জন্য ওরা খেলবে না। স্পেস দখল নিয়ে খেলবে। ব্রাজিলের সাথে খেলায় কিন্তু ওরা নেইমারকে আটকানোর জন্য কখনই খেলেনি। ওয়ান টু ওয়ান মার্কিংও করেনি। কিন্তু গোল খাওয়ার পর শেষমুহূর্তে গোল শোধ দিয়ে তাদের ম্যাচে ফিরে আসাটা ছিল খুবই সিগনিফিকেন্ট। এবং শেষে টাইব্রেকারে জয়ী হওয়া- এটি ছিল তাদের কৌশলের অংশ।’
আজও কি ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ টাইব্রেকারে নিতে চাইবে? এ প্রশ্নের জবাবে আশীষ ভদ্র বলেন, ‘সেটা বাস্তবে ঘটলে আর্জেন্টিনার জন্য খারাপ হবে। টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়া খুবই ভালো। বিগত দিনে টাইব্রেকারে উল্লেখযোগ্য ম্যাচে তাদের সাফল্য রয়েছে। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটিকে টাইব্রেকারে নিয়ে লাভ ঘরে নিতে চাইবে। ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষকটাও আত্মবিশ্বাসী।’
সবশেষে আশীষ ভদ্র বলেন, ‘আর্জেন্টিনার লৌতারো মার্টিনেজ এবং ডি মারিয়া আর্জেন্টিনার জন্য খুব ভালো সার্ভিস দিতে পারেননি এবারের বিশ্বকাপে। আজকে ডি মারিয়া ও মার্টিনেজকে দিয়ে হয়তো আবারও সেকেন্ড হাফে কিছু বের করার চেষ্টা করতে পারেন কোচ স্কালোনি। অবশ্য সবকিছুই তাকে করতে হবে ক্রোয়েশিয়ার মেজাজ-মর্জি বুঝে। একটু থেকে একটু হলেই সেই ভুলের খেসারত দিতে হবে। তবে আজকের রাত হতে পারে লিওনেল মেসির জন্য ভীষণ ভীষণ আনন্দময়। আর সেটা না হলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বিদায় নিতে হবে আর্জেন্টিনাকে। মেসির নতুন নতুন সৃষ্টিতে আজকের রাত হোক আলোকময়।’