“অনেক তরুণ নির্মাতা এই সময়ে বহু সীমাবদ্ধতা সত্বেও কষ্ট করে একটি ভালো ছবি বানানোর চেষ্টা করছেন, এই চেষ্টাটাই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়। সম্প্রতি আমি এক তরুণ নির্মাতার মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ‘করতলে ছিন্নমাথা’ নামের একটি ছবিতে ছোট চরিত্রে কাজ করেছি। যে তরুণ ছবিটি বানাচ্ছেন, সে নিজেই মরণব্যাধী রোগে আক্রান্ত। সে অবস্থায় ছবিটি নির্মাণ করছে। আমি ওর সাহস দেখে, সিনেমার নির্মাণের প্রতি নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তো এই ধরনের নিষ্ঠা নিয়ে এখন অনেক তরুণ নির্মাতা কাজ করছেন। ছবি বানানোর ব্যাপারে তীব্র ভালোবাসা তরুণদের অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করছি। তাদের এই তীব্র ভালোবাসাটা উস্কে দেয়াটাই চলচ্চিত্র সংসদগুলোর মূল লক্ষ্য বলে আমার মনে হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪৩০’ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বর্তমান সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় টিএসসিতে হয় ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪৩০’ এর সমাপনী অনুষ্ঠান। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে উৎসব সেরা পুরস্কার ‘আদিম’ ছবির নির্মাতা যুবরাজ শামীমের হাতে ‘হীরালাল সেন পদক’ তুলে দেন নূর।
তারআগে সিনেমা নিয়ে নিজের নানান অভিজ্ঞতার গল্প বলেন আসাদুজ্জামান নূর। এসময় তিনি তরুণ বয়সের গল্পও শোনান। সেই সময় ভিনদেশি একটি ছবি দেখতে কতো কসরত করতে হতো, সেই গল্পও বলেন তিনি। আর ঢাকা শহরে ভালো সিনেমা দেখার চর্চা শুরু করেছিলেন তারই বন্ধু প্রয়াত মুহম্মদ খসরু। এদিন তার কথাও স্মরণ করেন পর্দার বাকের ভাই!
বয়স হয়েছে, তবু ভালো চরিত্র পেলে নির্দ্বিধায় অভিনয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিবেন। এমন কথাও যেন এদিন বলে গেলেন তিনি। নূর বলেন, “আমরা যখন অভিনয় শুরু করেছি, তখন যে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে করতো না; তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেই সময়ে চলচ্চিত্রের যে দশা ছিলো, সেই অবস্থায় আমাদের অভিনয় করার সুযোগ ছিলো না। একটা দুঃসময় যাচ্ছিলো বাংলা চলচ্চিত্রে। এফডিসিতে যে ছবিগুলো তৈরী হতো, আমাদের করার মতো ছবি ছিলো না। এখন একভাবে বলা যায়, এখন আফসোস করি- এই সময়ে যে ধরনের ছবি তৈরী হচ্ছে, এমন ছবি যদি আমাদের সময়ে তৈরী হতো, তাহলে হয়তো অভিনয়ের সুযোগ পেতাম।”
সিনেমার চিত্রনাট্যে প্রবীণদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার বিষয়টিও উঠে আসে তার কথায়। নূর বলেন, অভিনেতা হিসেবে এখনো আমার ইচ্ছে করে, আরো বহু বছর ধরে মানুষ আমাকে অভিনেতা হিসেবে দেখুক। সেই আশা কতোটা পূর্ণ হবে জানি না। বয়স হয়েছে, চুল দাড়ি পেকেছে, দুই বছর পর আশি বছর হবে। আপনারা যারা চিত্রনাট্য লেখেন, এই বয়সের মানুষের জন্য তো অন্তত কেউ কিছু লেখেন না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখেছি, অনেক প্রবীণ অভিনয়শিল্পী অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন; কিন্তু আমাদের দেশে এটা দেখতে পারছি না। আমরা আবুল হায়াতের মতো মানুষকে দেখছি, সারা জীবন বাবা-চাচার অভিনয় করে দিন পার করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই মানুষটি যে কতো বড়মাপের অভিনেতা, যারা তাকে মঞ্চে দেখেছেন তারা বলতে পারবেন। তার মতো অনেক অসাধারণ অভিনেতাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম, তাদের সুযোগ করে না দেয়ার কারণে।
এই সময়ে যারা চিত্রনাট্য লিখছেন, নির্মাণ করছেন তাদের উদ্দেশে এসময় গুণী এই অভিনেতা বলেন, আমি জানি এই সময়ে সিনেমা নির্মাণ সহজ নয়। যারা বানান তারা বুঝেন। তবু তাদের একটু ভাবতে বলবো, প্রবীণ অসাধারণ অভিনয়শিল্পীদের ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় কিনা!
তরুণদের হাত ধরে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে শুরু করেছে জানিয়ে নূর বলেন, এখন খুব দারুণ সব ছবি নির্মিত হচ্ছে। যখন একটি ভালো ছবি দেখি, তখন মনটা ভরে যায়। আগে বিদেশি ছবি দেখলে একটা আফসোস হতো, ভাবতাম এরকম ছবি আমাদের হয় না কেন! খুবই সহজ সরল ছবি দেখেছি একসময়। যেমন ‘ব্যালাড অব আ সোলজার’। কোনো প্যাঁচ নেই, শুধু একটা গল্প আছে। মা যখন ছেলের গালে হাত দিয়ে বলছে, ‘ডু ইউ স্মুক?’। এই একটা বাক্যই ওই ছবিটার সব বলে দেয়। এভাবে যে সহজভাবে ছবির গল্প বলা, এটা এখনো আমাদের এখানে পুরোপুরি শুরু হয়নি। ‘বাইসাইকেল থিফ’ থেকে শুরু করে সত্যজিৎ কিংবা এরকম আরো যারা বড় বড় নির্মাতা, তারা কিন্তু সহজভাবে তাদের সিনেমায় একটা গল্প বলেছেন। দর্শকহৃদয় স্পর্শ করেছেন। এটি সবচেয়ে জরুরী বিষয় বলে মনে করি।
“একসময় বাংলা ছবির দর্শক ছিলেন আমাদের মা-বোনেরা। তারা দলবেধে হলে যেতেন, সিনেমা দেখে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বের হতেন। সেই দর্শক তো আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, হলে সেই পরিবেশ এখন নেই। ঢাকা শহরে কিছুটা জায়গা তবু আছে, কিন্তু ঢাকার বাইরে হলে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই। এটি একটি বড় সংকট। আমি নিজে যে শহরে থাকি, সেই জেলা শহরে এখন একটি সিনেমা হলও নেই। এরচেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে, আগে তিনটি সিনেমা হল ছিলো। আমাদের সময়ে হয়তো আমরা ভালো নির্মাতা তৈরী করতে পারিনি, কিন্তু ভালো দর্শক তৈরী করেছিলাম। এখন একটা জায়গা তৈরী হয়েছে, তরুণরা একের পর এক ভালো ছবি তৈরী করলে ইন্ডাস্ট্রির চেহারা বদলে যাবে।”-বলছিলেন আসাদুজ্জামান নূর।