১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আর্জেন্টিনার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিলেন এবং মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি।
আমাদের দেশের জন্মকালীন সময়ের ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা আর্জেন্টিনার সাথে এক আত্মীক সর্ম্পক তৈরি করে ফেলেছে। প্রজন্মের কাছে যদিও এই ঘটনা খুব একটা পরিচিত না, কিন্তু ফুটবল জাদুকর ডিয়াগো ম্যারাডোনা ও বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার লিওনেল মেসির কারণে বাংলাদেশের কোটি মানুষের জানা-চেনা দেশ আর্জেন্টিনা। এদেশের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের নানা আয়োজন-উল্লাস নজরে এসেছে বিশ্ববাসীর। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ভক্তদের কারণে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম।
বিগত কয়েকটি বিশ্বকাপ আয়োজনের সময়েই এ বিষয়টা বাইরের দুনিয়ার মনোযোগ কেড়েছিল। তবে এবারের কাতার বিশ্বকাপের সময়ে বাংলাদেশের মানুষের এই সমর্থনের বিষয়টি আর্জেন্টিনার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বেশ গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচার করছে। বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বরে পুরো বিশ্বের মতো আক্রান্ত বাংলাদেশের সমর্থকদের উপস্থাপন করা হচ্ছে ভিন্ন মাত্রায়। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ না থাকলেও আর্জেন্টিনার পাশাপাশি ব্রাজিল ভক্তদের আয়োজন, উল্লাস আর অম্ল-মধুর ঠোকাঠুকিতে আমরাও যেনো বিশ্বকাপের অংশ।
আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনা চলছে। আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষ বাংলাদেশ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এবং সার্চ ইঞ্জিনে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আর্জেন্টাইনরা বাংলাদেশের মানুষের নি:স্বার্থ ভালোবাসায় এতটাই বিমোহিত যে, আর্জেন্টিনা দলের অফিশিয়াল টুইটারে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। এমনকি সে দেশের সর্বোচ্চ লিগের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের পতাকা হাতে লিওনেল মেসির একটি ফটোশপ করা ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। যা রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি পৌঁছে গেছে কোটি আর্জেন্টিনা নাগরিকের কাছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এবং তিনি বাংলাদেশের মানুষকে সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বিষয়টি শুধু ফুটবলেই থেমে থাকেনি ক্রিকেটে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ে অভিনন্দন জানিয়ে বহু আর্জেন্টাইন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন।
বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অবস্থান তেমন একটা উল্লেখ করার মতো না। এছাড়া ফিফার তালিকায়ও আমরা ১৯০ এর আশেপাশে অবস্থান করে অসহায়ত্ব জানান দিয়ে আসছি বহুবছর। এই বিষয়গুলোও নিশ্চয় নজরে আসছে বাংলাদেশ সর্ম্পকে জানতে আসা আর্জেন্টাইনদের। নিশ্চয় তারা অবাকও হচ্ছেন, যে দেশে ফুটবলের এতো ভক্ত, সেদেশ কেনো ফুটবলে এতো পিছিয়ে! এই অবাক হওয়া ও চিন্তার জায়গায় আর্জেন্টাইন ফুটবলের অভিজ্ঞতা-অবকাঠামো আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ (বিশেষ করে ফুটবল কূটনৈতিক পদক্ষেপ) নেয়া হয়।
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল নাইজেরিয়া ফুটবল দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে তুলে ধরেছিল বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে। লিওনেল মেসির খেলা সরাসরি দেখেছে বহু বাংলাদেশি ফুটবল ভক্ত। এছাড়া বহু আর্জেন্টাইন কোচ দেশের জাতীয় দলসহ ক্লাব ফুটবলে অবদান রেখেছে। এছাড়া বিশ্ব হকির অন্যতম সেরা দল আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দেশের হকি লীগ খেলে গেছেন।
বাংলাদেশের সাথে আর্জেন্টিনার একটি ভাল বাণিজ্যিক সর্ম্পক রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায় আর্জেন্টিনা। এ লক্ষ্যে ঢাকায় দূতাবাস চালুর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এবছর জুলাইতে ঢাকা সফর করেছেন আর্জেন্টিনার একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। দক্ষিণ আমেরিকার চারটি দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের বাণিজ্য ব্লক মারকোসারের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে আর্জেন্টিনার সহায়তা কামনা করা হয়েছে সেসময়ে। এশিয়া থেকে আর্জেন্টিনা প্রচুর পরিমাণে টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, তৈরি পোশাক রফতানির জন্য আর্জেন্টিনাকে সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। বাণিজ্য-রাজনৈতিক সর্ম্পক স্থাপনের পাশাপাশি খেলাধুলার ক্ষেত্রেও আর্জেন্টিনার সঙ্গে সর্ম্পক স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।
আর্জেন্টিনার বর্ণিল ক্রীড়া অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এগিয়ে যেতে পারে। দেশীয় ফুটবলে কোচিং, কারিগরি সহায়তা, বিশেষজ্ঞ সহায়তা ও তৃণমূল থেকে ফুটবলার বের করার নানা কার্যকর পদ্ধতি বিষয়ে আর্জেন্টিনার সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। এছাড়া দেশের পেশাদার লীগটাকে উন্নত ও প্রতিযোগিতামূলক করতে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে সর্ম্পক স্থাপন হতে পারে দু’দেশের কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। বাংলাদেশের কোটি আর্জেন্টিনা ভক্তদের যুগ যুগ ধরে থাকা নি:স্বার্থ ভালোবাসার বিষয়টি পজিটিভভাবে তুলে ধরে খেলাধুলার উন্নয়নে এধরণের পদক্ষেপ সময়ের দাবি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)