প্রায় সাত বছর পর ভারত সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চার দিনের এই সফর নিয়ে অনেক প্রত্যাশা দেশের জনগণের। প্রত্যাশার পাশাপাশি দেশে অনেক বছর ধরেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভারতবিরোধী রাজনীতিও। তার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে নিয়েও চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। কেন বাংলাদেশে এত ভারত বিরোধিতা বা কীভাবে ভারতবিরোধী রাজনীতি এত শক্তিশালী হচ্ছে?
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়্যারম্যান ড. অরুণ কুমার গোস্বামী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মূলত যারা পাকিস্তানপন্থী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারাই ভারত বিরোধিতা করছে। কেননা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে। আর এই সরকার যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে এবং নানাভাবে একাত্তরের পরাজিতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।ফলে একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা। এখন তারা যেকোন ভাবে তাদের অবস্থান জানান দিতে চায়, এই জন্যই তারা ভারত বিরোধিতার কথা বলে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে চাচ্ছে।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফিরোজ আল হাসান বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্ন প্রক্ষাপটে। ফিরোজ আল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, এটা এক বা দুদিনের না। ভারত আমাদের পুরনো বন্ধু হওয়ায় তাদের কাছে আমাদের চাওয়াটা অনেক বেশি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলোর সমাধানে তারা ততটা নমনীয়তা দেখায় না। সেজন্যই ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হচ্ছে ভারতবিরোধী রাজনীতি।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন আইন অনুযায়ী তিস্তা নদীর পানি আমাদের প্রাপ্ত অধিকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভারত দেবো দেবো করে এটাকে জিইয়ে রেখেছে। ফলে তাদের সঙ্গে আমাদের একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, আসলে ভারত আমাদের বন্ধু কিনা, কেন তারা শুধু নিজেদের স্বার্থকে এতটা প্রাধান্য দেয় তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যেসব চুক্তি সম্পন্ন হবে আপাতত নজর দিলে দেখা যায় সেগুলোতেও ভারতের স্বার্থ বেশি সিদ্ধি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের বঞ্চিত হবে এমন ধারণা জনগণের। তাই এই সফরে আমাদের স্বার্থ বিষয়ক চুক্তিগুলো যদি জনগণের সামনে উম্মুক্ত করা হয় তাহলেই এই ধারণার পরিবর্তন হবে।
সম্প্রতি ভারতে গরুর মাংস নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকাণ্ড নিয়েও দেশের মানুষের মনে এক ধরণের বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।কাগজে কলমে ভারত অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও আসলে কিন্তু তা নয় বলে মনে করেন ফিরোজ আল হাসান। এছাড়াও গত বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা নিয়ে ভারতের মনোভাব মানুষের মধ্যে এক ধরণের নেতিবাচকতা সৃষ্টি করেছে।
অধ্যাপক ফিরোজ বলেন, ছিটমহল সমস্যা যেভাবে সমাধান হলো সেইভাবে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করা দরকার। কেননা তিস্তার পানির অভাবে উত্তরাঞ্চলের মানুষ নানা সমস্যায় রয়েছে। তিস্তার পানি আমাদের নায্য অধিকার, কিন্তু বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যেন তারা আমাদের করুণা করে।
আমাদের দেশে জনগণের ধারণা, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ ভারত হয়ে যায়, ভারতকে বেশি সুবিধা দেয়। আর বিএনপি আসলে পাকিস্থানকে বেশি সুবিধা দিয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটেও সরকারের বিপক্ষের কর্মী-সমর্থকরা তাদের অবস্থান জানান দিতে ভারতবিরোধীতা করে থাকে বলে মনে করেন এই দুই শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
এশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চীন ও ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন যেমন আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করে তেমন ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে উষ্ণ করতে হবে।আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার জন্য আমাদের ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা জরুরি বলেও মনে করেন তারা। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতবিরোধীতা বিষয়টি সমাধান হিসেবে তারা জানান, দু’দেশের মধ্যে যে কোন ধরণের চুক্তি বিষয়ে জনগণকে পরিষ্কার ধারণা দিলে এ সমস্যা কিছুটা হলেও কমে আসবে। তবে কিছু মানুষের এমন আচরণকে সরাসরি ভারত বিরোধিতা বলতে চান না এই দুই অধ্যাপক, তাদের মতে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কারণে যে ক্ষোভের সৃষ্টি, এটা সেই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ।