২০১৫ ঘটনাবহুল একটি বছর। বছরটিতে বিশ্বজুড়ে যেমন কোথাও রাজনীতিতে এসেছে চোখে পড়ার মতো কিছু পরিবর্তন, কোথাও দেখা দিয়েছে দিনবদলের আগমনীবার্তা। কোথাও আবার আঘাত হেনেছে সহিংসতা, কোথাও মানব জীবনের নিরাপত্তাহীনতা আর মৌলিক অধিকারের চরম লুণ্ঠন।
চলুন তাহলে এক নজর দেখে আসি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো। তারপর আপনিই না হয় ঠিক করবেন কোন ঘটনার জন্য মনে রাখবেন বিদায়ী বছরটিকে।
ফ্রান্সে আতঙ্ক
নতুন বছর শুরুর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সাপ্তাহিক পত্রিকা শার্লি হেবদো’র অফিসে হামলা করে এক পুলিশসহ ১১ জনকে হত্যা করে ফরাসি দুই ভাই সাইদ ও শেরিফ কুয়াচি। এর কিছু সময় পরই আমেদি কুলিবালি নামের এক ব্যক্তি পূর্ব প্যারিসে একটি ইহুদি মুদি দোকানে ঢুকে গুলি করে এক পুলিশসহ ৪ ক্রেতাকে হত্যা করে।
এ ধরণের হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ৪০ বিশ্বনেতাসহ প্রায় ২০ লাখ ফরাসি নাগরিক বিশাল এক প্রতিবাদ র্যা লিতে অংশ নেয় যার স্লোগান ছিলো ‘জে সুই শার্লি’ (আমি শার্লি নই)।
বছরের পরের ভাগে ছোটখাটো আরো কয়েকটা হামলা এবং হামলার চেষ্টা হলেও আতঙ্ক তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে ফিরে আসে ১৩ নভেম্বর, যখন জঙ্গি সংগঠন আইএসের বন্দুকধারীরা বিভিন্ন বার, রেস্টুরেন্ট ও বাটাক্ল্যান কনসার্ট হলে হামলা চালিয়ে ১৩০ জনকে হত্যা করে। ১৯৪৫ সালের পর দেশটিতে এটিই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা। ঘটনায় দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
গ্রিসে সিরিজা’র উত্থান, পতন, আবারও উত্থান
গ্রিসের বামপন্থী রাজনৈতিক দল সিরিজা বছরের শুরুতে ব্যয় সংকোচনের প্রতিবাদ করে কর্মজীবী শ্রেণীর অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গিকার নিয়ে ইউরোপিয়ান রাজনীতিতে আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু জুলাই আসতে আসতে দলটি থেকে নির্বাচিত গ্রিক প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এবং তার অর্থমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো দেশটির ঋণ-সঙ্কট এবং জার্মান সরকারের কঠোর শর্তের চাপে ভেঙ্গে পড়ে। গ্রিস সরকার বাধ্য হয় ব্যয়-সংকোচন নীতিসহ ঋণদাতাদের বিভিন্ন শর্ত মেনে চুক্তিতে আসতে।
সেপ্টেম্বরে আবারও সিপ্রাস সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন। নতুন সরকার নিয়ে গ্রিস তৈরি হচ্ছে নতুন বছরে তার ঋণ সহায়তার প্রথম কিস্তি নিতে। পাশাপাশি আরো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সহ্যের অপেক্ষায় রয়েছে দেশটি।
আফ্রিকায় নৃশংসতা
সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞের একটি ঘটে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে। জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় লেক চাদের কাছে অবস্থিত দু’টি শহরে হামলা চালিয়ে কয়েকশো (মতান্তরে কয়েক হাজার) নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। নিহতের সংখ্যা এখনো নিশ্চিত না হলেও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, দু’টি শহরেরই বিশাল এলাকা হামলায় মাটিতে মিশে গেছে।
ছোটবড় হামলার ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালটি আফ্রিকার জন্য কেটেছে সন্ত্রাসের বছর হিসেবে। একদিকে উত্তর নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো, অন্যদিকে সোমালিয়া আর কেনিয়ায় একই কাজ করছিলো আল-শাবাব। ২ এপ্রিল আল-শাবাব জঙ্গিরা কেনিয়ার গ্যারিসা ইউনিভার্সিটি দখল করে ঠাণ্ডা মাথায় ১৪৮ কর্মচারী ও শিক্ষার্থীকে হত্যা করে।
একইভাবে অন্যান্য এলাকাতেও হামলা ও হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে কমবেশি সারা বছর জুড়েই।
ইউক্রেনে যুদ্ধ
১২ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ফরাসি ও ইউক্রেনিয়ান নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানোর উদ্দেশ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেন। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই পুতিনের মিত্র দলগুলো চুক্তিভঙ্গ করে। আর এতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আরো ব্যাপকভাবে।
প্রবল যুদ্ধের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনিয়ান বাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত ডিবলসিভ শহর ছেড়ে পালাতে সফল হয়। এর মধ্য দিয়ে পর্দা নামে ইউরোপের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এ যুদ্ধে মারা গেছে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষ।
কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা
এ বছর আমেরিকায় ঘটেছে পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হওয়ার বেশ কিছু বিতর্কিত ঘটনা। বছরের সবচেয়ে আলোচিত কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর ঘটনা ছিলো ফ্রেডি গ্রে’র মৃত্যু। ছুরি সঙ্গে রাখার অপরাধে ২৫ বছর বয়সী ফ্রেডি বাল্টিমোর থেকে গ্রেফতার হন এবং পুলিশের ভ্যানে থাকা অবস্থায়ই কোমায় চলে যান। মারা যান এক সপ্তাহবাদে। এ ঘটনায় বাল্টিমোর, ফার্গুসন ও মিসৌরিতে তীব্র প্রতিবাদ ও দাঙ্গা এবং ফলে গ্রেফতার, কারফিউ ও জরুরি অবস্থা জারি হয়।
১৭ জুন সাউথ ক্যারোলিনার একটি আফ্রিকান চার্চে এক শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর গুলিতে ১৭ কৃষ্ণাঙ্গ মারা গেলে আবার প্রতিবাদ শুরু হয়। এ ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও পরে এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্যই হয়নি।
নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প
এপ্রিলের ২৫ তারিখে ভরদুপুরে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আঘাত হানে হিমালয়কন্যা নেপালে। এটি ছিলো গত ৮০ বছরের ইতিহাসে দেশটির সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। প্রলয়ঙ্করী এ ভূমিকম্পে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। আহত হয় আরো ২৩ হাজার।
ভূমিকম্প এবং পরবর্তী কয়েক দফা আফটারশকের প্রভাবে হিমালয়ে বেশ কয়েকটি তুষারধসের ঘটনা ঘটে, যার ফলে পর্বতারোহীসহ ১৯ জন নিহত হয়। ভূমিকম্প, ভূমিধস ও তুষারধসের ঘটনায় বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়। ঘরহারা হয়ে খাবার, পানি ও জরুরি সহায়তা থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত ছিলো হাজারো মানুষ।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের দৌরাত্ম্য
জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানের মধ্য দিয়ে আইএস বিরোধী যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু এভাবে আইএসকে কোবেন শহর থেকে হটাতে সফল হলেও এক সপ্তাহের মাথায়ই দলটি ফিরে আসে দ্বিগুণ শক্তিতে। এমনকি ইরাকেও ছড়িয়ে পড়ে তারা।
প্রথমে ইরাকে ৩৭টি আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে কেন্দ্রীয় ইরাক দখল করে ফেলে আইএস। এরপর সিরিয়ার পালমিরা থেকে আসাদ সরকারকে উৎখাত করে। দেশগুলোর ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করতে থাকে একে একে।
আইএস নির্মূলে মার্কিন সেনা ছাড়াও মাঠে নেমেছে ব্রিটিশ ও রুশ সামরিক বাহিনী। হামলা চালাচ্ছে একের পর এক। দলটির হাত থেকে বেশ কিছু শহরের দখল ফেরত নিতে পারলেও এখনো সমান তালে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গি দলটি।
‘ট্রাম্প’ প্রসঙ্গ
সামনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিভিন্ন দলে চলছে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মনোনয়ন প্রচারণা। এদের মধ্যে ভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছেন রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প। জঙ্গি হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম প্রবেশ নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্রভাবে সমালোচিত হন তিনি।
এছাড়াও মেক্সিকান ও কৃষ্ণাঙ্গ, এমনকি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নিয়ে বিভিন্ন বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য সমালোচনায় মুখরিত হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। তবে এতে খ্যাতিও (বা কুখ্যাতি) প্রচুর জমেছে তার ঝুলিতে।
সমকামী বিয়ের বৈধতা
এ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও আয়ারল্যান্ডে হঠাৎ করেই আইনী বৈধতা পেলো সমকামী বিয়ে। বৈধতার ঘোষণাটি এমনই আচমকা এলো, যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত! সময়ের সাথে সাথে দেশ দু’টিতে জনগণের মতামত সমকামী বিয়ের বিপক্ষ অবস্থান থেকে পক্ষে চলে গেলেও একে বৈধতাদানের সিদ্ধান্ত যে এতোটা হুট করে চলে আসবে, তা হয়তো কেউ বুঝতেও পারেনি। ফলে সমকামীদের মধ্যে উল্লাস যেমন ছিলো তীব্র, তেমনি বিরোধীদের প্রতিবাদেও ছিলো ঝাঁঝ।
শরণার্থীর বছর
তিন বছরের আয়লান কুর্দির মৃতদেহের এই মনভাঙ্গা ছবি বিশ্ববাসীকে যেনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের যুদ্ধের ফলে বাস্তুহারা হাজার হাজার শরণার্থীর দুর্দশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এক ঝলক। স্রোতের মতো ইউরোপগামী এসব শরণার্থীদের কয়েকটি দেশ আশ্রয় দেয়া শুরু করলেও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলো আবার তাদের প্রবেশ ঠেকাতে কাটাতারের বেড়াসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
প্রথমে ইইউভুক্ত দেশগুলো ইইউ’র বেঁধে দেয়া শরণার্থী গ্রহণের কোটা মেনে নিলেও পরে তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। শীত মৌসুমের সঙ্গে বাড়ছে শরণার্থীদের দুর্দশা। ২০১৬-তে এর কতোটা কী সমাধান হবে সেটাই দেখার বিষয়।
হাজারো হাজির মৃত্যু
গত সেপ্টেম্বরে মক্কায় হজ পালনের সময় দু’টি পৃথক ঘটনায় পদদলিত হয়ে এবং নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ক্রেন ভেঙ্গে পড়ে কমপক্ষে আড়াই হাজার হজ পালনকারী নিহত হন। প্রতিবছরই এমন দু’একটা ঘটনা ঘটলেও এতোটা ভয়াবহ মাত্রায় নিহতের ঘটনা এই-ই প্রথম।
বিমান পড়ছে তো পড়ছেই
২০১৪ থেকেই বিমান দুর্ঘটনা এবং ভূপাতিত করার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটা। ২০১৫-তে তা থেমে থাকেনি। এ বছরের মার্চে দেড়শো যাত্রীসহ বিমান নিয়ে জার্মানউইংসের পাইলটের আত্মহত্যার ঘটনা কাঁপিয়ে দেয় পুরো বিশ্ব। আল্পস থেকে সেই বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে করতেই ২০১৪ সালে হারিয়ে যাওয়া এমএইচ থ্রিসেভেন্টি বিমানের ডানার অংশ ভেসে আসে ফরাসি দ্বীপ রিইউনিয়নের সৈকতে।
নভেম্বরেই ২২৪ যাত্রী নিয়ে সিনাই মরুভূমির ওপর বিস্ফোরিত হয় একটি রুশ বিমান। এরপর আবার সিরিয়া সীমান্তে তুরস্কের গোলায় রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। জরুরি অবতরণের সময় গুলি করে হত্যা করা হয় এক পাইলটকে।
সু’চির পুনর্জন্ম
১৯৯০-এ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পরও অং সান সু’চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি দলটিকে ক্ষমতা নিতে দেয়নি মিয়নমারের সামরিক সরকার। নোবেলজয়ী বাকস্বাধীনতার আন্তর্জাতিক প্রতীক সু’চিকে ১৫ বছর গৃহবন্দীও থাকতে হয়।
কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বছর পর অবশেষে আবারো এলেন ক্ষমতায়। আরেকবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উড়িয়ে দিলেন সামরিক শাসনের অবরোধ। কিচু কিছু আইনী বাধা ধরে রাখলেও এবার সু’চির গৃহবন্দীকারী সেনাপ্রধানরাও মেনে নিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল। তবে ৩টি মন্ত্রণালয় এবং সংসদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসন নিজেদের অধীনে রাখার শর্তে। রাখুক। তাও তো ক্ষমতা পাচ্ছেন অবশেষে সু’চি, পাচ্ছেন মুক্তির স্বাদ। এ যেনো তার পুনর্জন্ম।