দেশের চরাঞ্চলের মানুষের কাছে প্রিয় এক কণ্ঠস্বর ছিলেন জাতীয় সংসদের সদ্য প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার, বিশিষ্ট রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া এমপি। গত ২২ জুলাই শুক্রবার নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে তিনি প্রয়াত হন। অনেকদিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। বেশ কয়েক মাস ধরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি আমেরিকাতে ছিলেন। ওখানেই তিনি শেষনিঃশ্বাস করেন। পরে তাকে বাংলাদেশে এনে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে যে অতুলনীয় ছিলেন তা যে কেউ নির্বিবাদে স্বীকার করবেন। বরাবরই তিনি ছিলেন প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি ভরা নিরহংকার এক সাদা মনের মানুষ। একাধিকবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও জীবনাচারে ছিলেন অতি সাধারণ। যৌবনে সরকারে প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তবে দশম সংসদ থেকে একটানা তিনি ছিলেন ডেপুটি স্পিকার।
অভিজ্ঞ এই রাজনীতিক বড় বেশি পরিষ্ফুটিত ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে। জনমুখী নেতা ছিলেন তিনি। নিজ শিকড়কে কখনই ভুলেননি। তবে চরে বসবাসরত দুঃখী, অভাবী, সংগ্রামী মানুষের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ছিল বরাবরই। আর এ কারণেই তিনি চরের খেটে খাওয়া, সংগ্রামী সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণের মতো করে কথা বলতেন, মেলামেশা করতেন। কখনই তিনি নিজেকে আলাদা করে ভাবতেন না। চরের দরিদ্র মানুষের প্রতি তিনি এতোটাই দুর্বল ছিলেন যে তাদের উন্নয়নে, তাদের স্বপক্ষে তিনি সবসময় জোর গলায় কথা বলতেন। আসলে চরের মানুষের সুখ-দুঃখ ব্যাথা-বেদনার গল্পগুলো তার কাছে কখনই অজানা ছিল না। কেননা তিনি নিজেও ছিলেন চরের মানুষ। সেই শৈশব-কৈশর থেকেই তিনি চরের মানুষকে দেখতে দেখতে বড়ো হন বলে চরের মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে তাঁর ছিল স্বচ্ছ ধারণা। নিজেকে ‘চরো’ মানুষ হিসেবে সবসময় পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন।
কয়েকদিন আগে চরের মানুষের অধিকার নিয়ে কর্মরত জাতীয় পর্যায়ের জোট ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’ অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার স্মরণে অনলাইনে একটি স্মরণসভার আয়োজন করেছিল। সেই স্মরণসভায় যোগ দিয়েছিলেন সারাদেশে চরের মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ। স্মরণসভায় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আতিউর রহমান।
আবেগঘন সেই স্মরণ সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘রাজনীতিতে অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার মতো প্রজ্ঞাবান মানুষ একেবারেই বিরল। এরকম মানুষ রাজনীতিতে থাকলে রাজনীতির গুনগত মান যেমন বেড়ে যায়, তেমনি রাজনীতি আলোকিতও হয়। এরকম রাজনীতিবিদ থাকলে মানুষ আশান্বিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের যোগ্য প্রতিনিধি। চরের মানুষের কথা শুনলেই যিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে চাইতেন।’ তিনি আরও বলেন, অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়া জনবান্ধব এক রাজনীতিবিদ ছিলেন বলেন বরাবরই চরের মানুষের পক্ষে সত্যটা উচ্চারণ করতেন। চরের মানুষের স্বার্থের কথা বলতেন। একই সাথে দেশের সমগ্র মানুষের কথা বলতেন। তিনি একই সাথে সংসদের অভিভাবক ছিলেন। দলীয় দৃষ্টিকোণের বাইরে তিনি সবার অংশগ্রহণের সমাজের স্বপক্ষে কথা বলতেন। তার স্মৃতি ধরে রাখতে, তার চিন্তা ও কর্মকে এগিয়ে নিতে আমাদের কাজ করতে হবে।’
তিনি সত্যিই মনেপ্রাণে চরের মানুষের উন্নয়নের কথা বিশ্বাস করতেন। ২০১৭ সালের একটি ঘটনার কথা বলি। ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর উদ্যোগে জুলাই মাসের দিকে চরের মানুষের উন্নয়নে একটি স্থায়ীত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে মাননীয় সংসদ সদস্যদের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর সদস্য সচিব হিসেবে বিষয়টি আমি নিজে সমন্বয় করছিলাম। বিষয়টি নিয়ে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার সাথে আমরা সংসদ ভবনে তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করি। তিনি ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর টিমের সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। চরের মানুষের অধিকারে জোটের নেওয়া উদ্যোগ অবগত হয়ে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, সবার আগে তিনি স্বাক্ষর করবেন। কোনো প্রশ্ন না করেই হাসতে হাসতে কলম হাতে নিয়ে তিনি স্বাক্ষর করেন। এরপর তিনি আরো অনেক সংসদ সদস্যকে চরের মানুষের উন্নয়নে দাবির সমর্থনে স্বাক্ষর করার জন্য অনুরোধ করেন।
আরেকটি উদাহরণ দিই। ২০১৬ সালের ২৭ জুনের কথা। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত বাজেট অধিবেশনে ডা. দীপু মনি এমপি তার বক্তব্য উপস্থাপনা করেন। সেদিন সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করছিলেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। বক্তৃতার এক পর্যায়ে ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, ‘চরের উন্নয়নে বারবার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিন্তু টাকা অব্যবহৃত রয়ে গেছে, খরচ হয়নি। চরের মানুষের উন্নয়নে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’ ডা. দীপু মনি এমপি বক্তব্য উপস্থাপনের পরপরই ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার পাশাপাশি চরের মানুষের উন্নয়ন বিষয়ে একমত পোষন করে বলেন, ‘আপনার সুর ধরে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, চরের মানুষের উন্নয়নে একটি চর বোর্ড বা চর ফাউন্ডেশন গঠন করা যেতে পারে।’
আগেই বলেছি চরের মানুষের জন্য ভীষণ রকম নিবেদিত এক প্রাণ ছিলেন ফজলে রাব্বী মিয়া। আসলে এর পেছনে অন্তর্গত কারণও ছিল। তিনি ছিলেন চরে বেড়ে ওঠা এক মানুষ। চরের মানুষের জীবনের সাথে তাঁর পরিচয় ছিলো সেই কৈশরে। খুব কাছ থেকে বারবার দেখেছেন চরের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, অভাব, লড়াই আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দেখেছেন বন্যা চলা কালে চরের নিরন্ন মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দেখেছেন বিস্তর নদীভাঙ্গন। এ সব কারণে কখনই চরের মানুষকে হৃদয় থেকে, মন থেকে তিনি মুছে ফেলতে পারেন নি। বরং মনের মধ্যেই রেখেছেন তাঁদের। আর তাই সবসময়ই দেখেছি পার্লামেন্ট সেশনে বিরতি পড়লেই তিনি আর ঢাকায় থাকতেন না। চলে যেতেন চর এলাকায়। চরের মানুষের কথা শুনতেন। তাদের অভাব, অভিযোগ, ভালোমন্দ আমলে নিতেন।
অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়া ভীষণ রকম বড় মনের মানুষও ছিলেন। সবার সাথে মন খুলে কথা বলতে পছন্দ করতেন। কাউকে কষ্ট দিতে জানতেন না। হাসিমুখে কথা বলতেন। তার অফিস কক্ষে কেউ গেলে সবার আগে চা-নাস্তা খাওয়ার কথা বলতেন। সবাইকে বলতেন, ‘আগে খাওয়া-দাওয়া পরে কথাবার্তা।’ সবাইকে নাস্তা আর ভালো দুধ চা খাইয়ে তিনি যেনো মহা তৃপ্ত হতেন। রসিক মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। হাস্যরস করতে ভালোবাসতেন। নিজ এলাকার মানুষ গেলে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন।
তবে বলতে দ্বিধা নেই পার্লামেন্ট পরিচালনা করার ক্ষেত্রে তিনি অগাধ জ্ঞান রাখতেন। যখনই পার্লামেন্ট সেশন চালিয়েছেন সেটা সুন্দর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অটল থেকেছেন। কঠোর নয়, পার্লামেন্টকে প্রাণবন্ত রাখতে পার্লামেন্ট কক্ষে সবসময় হাস্যরস ছড়িয়ে দিয়েছেন।
অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়া চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। আমরা অনেককেই দেখেছি বড় পদ পাওয়া পর ভীষণ রকম বদলে গেছেন। এলাকার মানুষের সাথে বিস্তার ব্যবধান তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার বেলায় এসব কখনই হয়নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সবার ভালবাসা পেয়েছেন। আর তাই ‘ভেলু মিয়া’র (এলাকায় যে নামে পরচিত) মৃত্যুতে চরের মানুষ না কেঁদে পারেনি। তার জানাজাতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। চরের মানুষের প্রিয় কণ্ঠস্বরের বিদায়ে সেদিন গাইবান্ধার চরাঞ্চলে নেমে এসেছিল মায়াবী নীরবতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)