চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে ইতিহাসের স্মৃতিচারণ

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ঐতিহাসিক ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। কালের পরিক্রমায় আজ পহেলা ফাগুনও। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এদেশের ছাত্র সমাজ জাতির কাঁধে চেপে বসা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে।

ফাগুনে আগুন, প্রতিবাদী ছাত্র সমাজের বুকের রক্তে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলির মতো কালো রাজপথকে রক্তিম করে তুলেছিল। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদ সাথীকে।

Bkash July

পাকিস্তানী ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৩ বছরের সংগ্রাম, চূড়ান্তভাবে নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দু’লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে একেবারে উল্টোপথে ধাবিত করার চেষ্টা করা হয়।

Reneta June

‘ক্যু-পাল্টা ক্যু’র মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে বাঙ্গালী জাতির আশা আকাঙ্খা। সামরিক শাসকদের পালা বদল হয় জিয়া থেকে এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মোহামম্দ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ওই দিনই ছাত্ররা স্বত:স্ফুর্তভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সোচ্চার হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশি বাধায় সে মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার গণ অভ্যুত্থান দিবসে, ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ কলাভবনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এই মিছিলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহ বহু ছাত্র-ছাত্রী আহত ও গ্রেপ্তার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণাঙ্গনে। দিনশেষে সিদ্ধান্ত হয় ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কখনো পুলিশ প্রবেশ করতে পারবে না। ক্যাম্পাস হয় মুক্তাঞ্চল।

তিন দফা দাবিকে সামনে রেখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দাবিগুলো হলো মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, সব ছাত্র ও রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তিদান ও সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

সেই লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতা ছিলাম তাদের ঘরোয়াভাবে ডেকে বললেন, অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে যখন আমরা প্রশ্ন করলাম, কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা একান্তে বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় আমাদেরই পরম পূজনীয় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবন বাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা।

এদেশের ছাত্র-জনতার শত বছরের আকাঙ্ক্ষা গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মূলত সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচিতে শামিল হয়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার। শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়েন শত শত শহীদ যাদের লাশ গুম করা হয়েছিল পরবর্তীতে। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সামরিক শাসককে মোকাবিলা করার জন্য তখনো তেমনভাবে প্রস্তুত ছিল না। তবুও ছাত্র-জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। সেই কারণেই আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করি।

এ কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।

১৯৯৩ সালে সেই শক্তির উপদেষ্টা সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন ‘ভালোবাসা দিবস’। ‘যায়যায়দিন’ খ্যাত সাপ্তাহিকে পরকীয়ার আখ্যান ‘দিনের পর দিন’ কলামে ‘মিলা ও মইনের’ টেলিফোনে কথোপকথনের ভালোবাসার মূর্তরূপ ধারণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতার হলুদাভ বস্ত্রের ও গাঁদা ফুলের মর্মর মিলনমেলার আচ্ছাদনে। নগর থেকে বন্দর রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গন ছেয়ে যায় হলুদাভ ভালোবাসায়।

আজ আমরা যে ভালোবাসা দিবস পালন করছি এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্যও রয়েছে। সে প্রায় সাড়ে সতেরশ ’বছর আগে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা।

২৭০ খ্রিস্টাব্দে তখনকার দিনে ইতালির রোম শাসন করতেন রাজা ক্লডিয়াস-২, তখন রাজ্যে চলছিল সুশাসনের অভাব, আইনের অপশাসন, অপশিক্ষা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং কর বৃদ্ধি। এতে প্রজাকুল ফুঁসছিল। রাজা তার সুশাসন ফিরিয়ে রাখার জন্য রাজদরবারে তরুণ-যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর যুবকদের দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কারণ, রাজা বিশ্বাস করতেন বিয়ে মানুষকে দুর্বল ও কাপুরুষ করে। বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলো।

এ সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক যাজক গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন; তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালোবাসার বন্ধু’ নামে। কিন্তু তাকে রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে আটক করা হলো। জেলে থাকাকালীন ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় হয় জেলরক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সঙ্গে। আস্ট্রেরিয়াস জানত ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীতে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।

এতে মেয়েটির সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাজা তার এই আধ্যাত্মিকতার সংবাদ শুনে তাকে রাজদরবারে ডেকে পাঠান এবং তাকে রাজকার্যে সহযোগিতার জন্য বলেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগিতায় অস্বীকৃতি জানান।

এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের ঠিক আগের মুহূর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লিখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষণে লেখা হয় ‘From your Valentine’, এটি ছিল এমন একটি শব্দ যা হৃদয়কে বিষাদগ্রাহ্য করে। অতঃপর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই থেকে সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ পালন করা হয়।

চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সমাজকে এ জায়গা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের দুর্বলতা, সমাজে মৌলবাদ, দুর্নীতি, লুটপাট, নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়।

তাই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আমরা সেই শপথ নেই।

বীরেরা বারবার আসে, বারবার যুদ্ধে যায়, শহীদের রক্ত আত্মদান কখনো বৃথা যায়নি। আজ অথবা কাল শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View