ভারতের ওড়িশায় চেন্নাইগামী ট্রেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৮০ জন মারা গেছেন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভারতের দুই রাজ্য ওড়িশা এবং তামিলনাড়ুতে একদিনের শোক পালন হচ্ছে।
এ ঘটনায় ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবও পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে ঘটনাস্থলে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন।
দুর্ঘটনায় ইতোমধ্যে উদ্ধারকাজে নেমেছে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রিলিফ ফোর্সের (এনডিআরএফ) সদস্যরা। রয়েছে ওড়িশা ডিজাস্টার র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সও (ওডিআরএএফ)।
করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি নাগরিকদের সার্বিক যোগাযোগের জন্য কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপহাইকমিশন হটলাইন নাম্বার দিয়েছে। নাম্বারটি হচ্ছে- +৯১৯০৩৮৩৫৩৫৩৩ (হোয়াটসঅ্যাপ)। যেকোন বিষয়ে দূতাবাসের এই নাম্বারে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে বালাসোর জেলার বাহানগা বাজার রেল স্টেশনের কাছে আপ শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে যায়। দুর্ঘটনার তীব্রতা এতই ছিল যে যাত্রীবাহী ট্রেনটির ইঞ্জিন উঠে যায় এক মালগাড়ির ওপর। ট্রেনের অধিকাংশ বগি ছিটকে পড়ে পাশের লাইনে। এই সময় উলটো দিক থেকে আসা যশবন্তপুর-হাওড়া হামসফর এক্সপ্রেসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে করমণ্ডলের লাইনচ্যুত বগিগুলিকে। তিনটি ট্রেনের এই সংঘর্ষে যেন মৃত্যুমিছিল চলছে।
এমন চিত্রই পাওয়া যায় দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটির এক যাত্রীর কাছ থেকে। ট্রেন যাত্রায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ঘড়িতে তখন সময় সন্ধ্যা ৭টা। ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রীরা ঘুমাচ্ছিলেন। আমি কখনও ভাবতেও পারিনি এই অল্প সময়ে এমন কিছু হয়ে যাবে। আমরা সবাই নিজেদের মতো আরামে বসে ছিলাম। আমিও কিছুটা তন্দ্রাছন্ন অবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ বিকট ঝাঁকুনিতে সব উলট-পালট হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম, সহযাত্রীরা ঝুলন্ত বার্থ থেকে কেউ আছড়ে পড়লেন, কেউ ছিটকে গেলেন অনেকটা দূরে। যারা বসেছিলাম, তারাও হুমড়ি খেয়ে সজোরে আছড়ে পড়লাম বগির মেঝেতে। এতক্ষণেই দেখলাম অনেকে আহত হয়ে গেছে। কারও মাথা ফেটে গেছে তো কারও হাত-পাতে গভীর আঘাত। তড়িঘড়ি দরজা খুলে বেরোতে গিয়েও পারলাম না। কারণ, বগির পরপর জানালা, দরজার কাঁচ ভেঙে খুঁটি আর তার তালগোল পাকিয়ে ভিতরে ঢুকে এসেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, স্থানীয়রা না থাকলে বাঁচাটা প্রায় অসম্ভব ছিল। ওরাই কোনরকমে আমাদের বগি থেকে টেনে টেনে বের করলেন। বাইরে এসে দেখলাম, রেললাইনের ধার বরাবর একের পর এক বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি দুমড়ে-মুচড়ে আছড়ে পড়েছে বগির গায়ে।
গৌতম আরও বলেন, আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলাম- না হলেও শতশত মানুষ মারা গেছেন। আহত কয়েক শতাধিক। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় ক্রমশ ঘটনাস্থল ছেড়ে খানিক এগিয়ে গেলাম। আর্তনাদ, অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন সব মিলিয়ে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। এমন ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী যেন আর কাউকে না হতে হয়।
বালাসোরে দুর্ঘটনার জেরে আজ ভারতের একাধিক ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। হাওড়া, শালিমার থেকে ছাড়বে না বহু ট্রেন। হাওড়াগামী বহু ট্রেনও বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে বহু ট্রেনের যাত্রাপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাতিল হওয়া ট্রেনগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো – ২২৮৯৫ হাওড়া-পুরী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস, ২২৮৯৬ পুরী-হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেস, ১২৭০৩ হাওড়া-সেকেন্দ্রাবাদ ফলকনুমা এক্সপ্রেস, ১২৮২১ শালিমার-পুরী ধৌলি এক্সপ্রেস, ১২৮২২ পুরী-শালিমার ধৌলি এক্সপ্রেস, ১৮০৪৫ শালিমার-হায়দরাবাদ ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেস, ২২৮৯০ পুরী-দিঘা সমুদ্রকন্যা এক্সপ্রেস।
অন্যদিকে ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের ২ লাখ রুপি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ দুর্ঘটনাকে ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৩ সালে ওড়িশার জাজপুর জেলায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। এবারের দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেটি ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে।