‘মেঘদল’ শহুরে তরুণদের ক্রেজ! শ্রোতাদের নয় বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের নতুন গান ‘এসো আমার শহরে’। গানের মানুষ ছাড়াও শিল্প-সাহিত্যমনা মানুষের কাছেও গানটি বেশ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। নতুন গান নিয়ে, গানের পেছনের গল্প এবং নির্মাণ-ভাবনা নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে কথা বলেছেন ‘মেঘদল’-এর ভোকালিস্ট, গীতিকার, সুরকার শিবু কুমার শীল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুয়েইরিযাহ মউ:
মেঘদলের শেষ রিলিজ হওয়া গান নিয়েই আলোচনা শুরু করা যায়। নয় বছরের বিরতির পর মেঘদল- নতুন গান নিয়ে এসেছে। এ গানের প্রস্তুতি-পর্ব কতদিনের ছিল?
এ গানের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিল বলা যায় তিন-চার বছর আগে। এটা একটা আহ্বান আসলে, এই শহর একটা নেক্রপলিস। এখানে সব ধরণের বিষাদগ্রস্ততা এসে ভর করেছে। তবু এরকম একটা অবস্থার মধ্যেও এ শহরে আহ্বান জানানো হচ্ছে। আমরা ‘অ্যালুমিনিয়ামের ডানা’ নামে যে প্রজেক্ট শুরু করেছি সেই অ্যালবামের প্রথম ট্র্যাক হিসেবে এ গান রিলিজ দেওয়া হল। আপনি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন আমরা একটা প্রমো ছেড়েছিলাম কয়েকদিন আগে, তার মধ্যে এই গানের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।
এই যে নয় বছর বিরতি, বিশাল এই গ্যাপে মেঘদলের শ্রোতা,অনুরাগীদের চাপগুলো কীভাবে ফেস করেন? চাপতো ছিলো নিশ্চয়?
হ্যাঁ, নয় বছর আমরা অফিসিয়ালি কোন ট্র্যাকই রিলিজ করিনি। চাপতো ছিলই ডেফিনেটলি, যদিও খুব বেশি শ্রোতা নেই ‘মেঘদল’-এর। তবে বুয়েটে বা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গান করতে গেলে আমরা বুঝতে পারি এরকম বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণদের একটা অংশ আমাদের শ্রোতা। তারা অপেক্ষায় ছিলেন, আমাদের প্রশ্ন করেছেন বার বার। কিন্তু আমরা একটা বিষয়ে অনড় ছিলাম যে যতদিন প্রোপারলি টিম প্রস্তুত না হচ্ছে শুধুমাত্র বাজারের চাপে আমরা গান রিলিজ করবো না।
এর মধ্যে একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করলাম যে ইন্ড্রাস্ট্রির চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মানুষের গান শোনাটা এখন ইউটিউবকেন্দ্রিক লাইক-সাবসক্রাইবের দিকেও চলে গেছে। শ্রোতা এখন শুধু গান শুনছেন না গানের ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্টেশনকেও গুরুত্ব দিচ্ছে্ন। আপনি দেখুন এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় বেশ কিছু ব্যান্ডের নতুন গান এসেছে, কিন্তু আলোচনা সেভাবে হচ্ছে না গানগুলো নিয়ে। কেন? তারা যে খুব খারাপ গান গাইছে তা তো না। দেখা যাচ্ছে যে ভিজ্যুয়াল তৈরি করা সম্ভব না হলে শ্রোতার কাছে সে অর্থে পৌঁছোনো যাচ্ছে না। শ্রোতাদের এই ট্রানজিশনের কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যত দিন পর্যন্ত মিউজিকের সমমানের, সেই উচ্চতার কোন মিউজিক ভিডিও তৈরি করা না যাচ্ছে আমরা গান রিলিজ দিবো না।
‘এসো আমার শহরে’ – এ শহর আদতে কোন্ শহর?
বলা যায় এই শহর আমার আজকের শহর। কিংবা সেই প্রাচীন মেঘময় শহর, যে শহর আমি-আমরা বুকের মধ্যে লালন করি। শহর নিয়ে এক ধরণের অবসেশন যে শহর জন্ম দেয় এ শহর সেই শহরও। এই শহরের আজকের অবস্থা তো আরও করুণ। প্রতিবাদ বা ভালোবাসা কোনটাই যেন এ শহরে নেই। এই একলা পাখির শহর, শহরবন্দী মেঘের শহর, যেমন স্যাটায়ার আছে তেমনি এসমস্তে আছে তীব্র বিষাদগ্রস্ততাও। আবার নস্টালজিক করে দেওয়ার শহরও এই শহরই।
আপনার লেখা লিরিক্সে গ্রিক কিংবা মিশরীয় মিথোলোজি কিংবা প্রাচীন গ্রিক-মিশরীয় কিছু শব্দ বেশ আসে বলে মনে হয়। আপনি কি গ্রিক-মিশরীয় শব্দের প্রতি আকৃষ্ট হোন খুব?
আমি ঠিক ওভাবে দেখি না বিষয়টাকে। আমার একাডেমিক পড়াশোনা ফাইন আর্টসে। তো সেকারণে আমাকে এসমস্ত চরিত্র নিয়ে জানতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে। আমার কাছে নেফারতিতির ভাবনা প্রেমময় এক অনুভূতি। আমি আফ্রোদিতির ভাস্কর্য দেখেছি। সে সম্পর্কে জেনেছি। শিল্পকলার ইতিহাসে মিথোলজিক্যাল বিষয় সম্পর্কে আমাকে পড়তে হয়েছে। এটা থেকে এক ধরণের অবসেশন, প্রেম-বোধ অবচেতনে কাজ করে হয়তো।
আরেকটা বিষয় মজার, ঐ শব্দগুলোর সাথে আমাদের খুব চেনা শব্দের মেলবন্ধন ঘটানো। যেমন ধরুন এ গানেও- “তবু, এই বিষাদগ্রস্ত মেঘময় প্রাচীন শহর /বারবার তোমাকে ফিরে পেতে চাইবে /এই করুণ নেক্রপলিসে।” – ‘করুণ নেক্রপলিস’ শব্দদ্বয়কে নিজে কীভাবে ভাবেন?
এই যে দু’টো শব্দ, একটা ওয়েস্টার্ন আরেকটাকে জীবনানন্দীয় বলা চলে। হয় কী, আমরা যখন নিজস্ব ভাষার সাথে বিদেশী শব্দকে মেশাতে পারি তখনই আত্মীকরণ সম্ভব হয়। তখন আমরা সেটাকে নিজের মনে করি। বিশ্বের যেকোন প্রান্তের বিষাদগ্রস্ততা আপনাকে ছুঁয়ে যাবে তখনই যখন সেটাকে আপনার আর আরোপিত মনে হবে না। গ্রিক ট্রাজেডি আমাদের এতোটা নাড়া দেয় কখন, যখন কোন অনুবাদক আমাদের নিজস্ব ভাষায় সেটা অনুবাদ করে আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আমাদের নেক্রপলিস ওয়েস্টার্ন থেকে আমাদের নিজস্ব হয়ে উঠছে এই করুণ শব্দের মধ্য দিয়ে। তবে এটাও অজান্তেই লিরিক্স লেখার সময় লিরিক্সে জায়গা করে নেয়।
‘শহর’ শব্দটা ইদানীং মেঘদল-এর গানের সিগনেচার এক দিক দিয়ে, শব্দের এই ব্যাপারকে কীভাবে দেখেন? বা এইযে বিষাদগ্রস্ত, ধুলো এসব শব্দের রিপিটেশন?
আমাদের জীবনই তো এক রিপিটেশন। আমি জানি আমি প্রাত্যহিক কী কী করবো, আমি জানি আমার জন্ম হয়েছে আমি মারা যাবো, আমরা প্রত্যেকেই এই রিপিটেশনের অংশ! আমি জানি প্রতিদিন বিকেলের আকাশের রঙ এমনই হবে। তবু প্রতিটি পর্ব একটা থেকে আরেকটি পৃথক।
আর্টের ক্ষেত্রেও রিপিটেশন কমন একটি বিষয়। আপনি দেখুন আমি যদি তারকাভস্কি কিংবা বার্গম্যানের চলচ্চিত্রের কথা বলি, কোন না কোন মোটিভ প্রতিটি চলচ্চিত্রেই হাজির আছে কোন না কোনভাবে। জেমস জয়েস এর ‘ইউলিসিস’ এ শহরের প্রতি যে অবসেশন, সৈয়দ শামসুল হক-এর লেখায় জলেশ্বরীর উপস্থিতি কিংবা শহীদুল জহির যে বার বার নয়নতারা ফুলের কথা বলে গিয়েছেন অনেক লেখাতে, সমস্তই তো রিপিটেশন। এসমস্ত রিপিটেশনকে আমার সফল রিপিটেশন বলে মনে হয়। তাই রিপিটেশন নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই, কিন্তু আমি ভাবি কনটেন্ট আলাদা হল কী না। একই ‘বিষাদ’ শব্দ দিয়ে যেমন নেফারতিতির চলে যাওয়ার বিষাদগ্রস্ততা বুঝানো হচ্ছে, আবার সেই বিষাদই তো বোঝায় “এই পৃথিবীর বিষন্ন ধুলোয় মিশে যেতে পার। / তবু, এই বিষাদগ্রস্ত মেঘময় প্রাচীন শহর / বারবার তোমাকে ফিরে পেতে চাইবে”। বিষাদও এখানে রিপিটেশনের পরেও রুপান্তরিত হয়েছে এক ফর্ম থেকে আরেক ফর্মে।
গানের সাথে দৃশ্যের গুরুত্বের কথা বলছিলেন একটু আগে। ‘এসো আমার শহরে’ গানের দৃশ্যায়নের গল্প আপনি এবং মেজবাউর রহমান সুমন লিখেছেন। এই যে মেটাফোরের ব্যাপারটা। ধরুন রাতে শহরে একা হরিণ, নারীর এই যে ঘোড়া-জীবন, জোনাকী গায়ে হেঁটে চলা পথিক, গাছভর্তি মাথাসহ শরীর – আপনাকে যদি কথা বলতে বলি এ নিয়ে কী বলবেন?
আমি আর সুমন না শুধু, আরেকজন ছিলেন, জাহীন ফারুক আমিন। আমরা তিন জন প্রথমে যখন শহরকে পোট্রেট করতে চাইছিলাম তখন আমরা ভাবলাম কীভাবে এ শহরের ছবি দেখানো যায়। পুরনো শহর, ঐতিহাসিক শহর– এভাবে এ শহরকে অনেকবার দেখা হয়ে গেছে। তো এসমস্ত দেখার দৃশ্যের বাইরে এমন এক শহর আমরা দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছিলাম যা চোখের আড়ালে থাকে। দেখুন এই মুহূর্তে আপনি-আমি কথা বলছি কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তেই কি একটা কেঁচো রাস্তা পার হচ্ছে না? একটা পিঁপড়ে কি কোথাও হাঁটছে না দেয়ালের গায়ে। এই ওয়াইল্ড লাইফ এটা আসলে এই নেক্রপলিসে ডিজেবল হয়ে যেতে থাকে, কিন্তু আসলে এসব তো উপস্থিত এবং বর্তমান। সাপ, ব্যাঙ, প্যাঁচা তো আছেই আমাদের আশেপাশে। এসবের বাইরে মেটাফরভিত্তিক ভাবনা তো ছিলই। যেমন- মুখোশকে আমরা শেষমেশ ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে দেখি, কিংবা ছোট বাচ্চাটা জোনাকী দেখতে থাকে তার চারপাশে। অনেক বীভৎসতার পরেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এই নেক্রপলিসেও আশাবাদ জাগে!
আপনার লিরিক্সে ‘নাগরিক জীবনকে ঘিরে থাকা’ শব্দ এবং দৃশ্যকল্পের প্রাধান্য দেখা যায়, সেটা কী এই কারণে যে আপনার যাপিত জীবন এর মধ্যে না কি গানগুলোও আসলে শহরকেন্দ্রিক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছোচ্ছে বলেই। কিংবা দু’টোই কি পরস্পরযুক্ত?
আধুনিক বাংলা কবিতার ধারার দিকে যদি তাকাই কিংবা সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের দিকে, এই পরম্পরা ধরে বাংলা গানের লিরিক্সও তো আগাচ্ছে। যখন আমি লিরিক্স লিখছি তখন আমার মাথায় ৫০-৬০-১০০ বছরের সাহিত্য পাঠের-পরম্পরার মধ্য দিয়ে জেগে থাকছে, আমার মাথায় শহীদুল জহির, মাহমুদুল হক এরকম অনেকে থাকছেন, তো আমার এই শহর দেখা তো আমার একার দেখা শহর নয়। আমি ফলে এ ব্যাপারটা এভাবেই দেখতে চাই।
আপনার শ্রোতাদের মধ্যে দেখা যায় অধিকাংশ শিল্প-সাহিত্য সরাসরি চর্চা করছেন এমন মানুষজন বেশি। এর বাইরে আপনার গান প্রচারের দৃশ্য বিবেচনা করলে আপনার আসলে কী মনে হয়, আপনার শ্রোতা কারা?
একজন শিল্পী যদি সততার জায়গা থেকে বলে তবে বলতে হয় একজন লেখক তার নিজের জন্য লিখছেন, শিল্পী তার নিজের জন্য গান গাইছেন। প্রথম কথা হল নিজস্ব জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, আত্মার শান্তির জন্য গান লিখি কিংবা গাই আমরা। তবে হ্যাঁ এটাও সত্য একটা গান যেমন লেখা হয় তেমনি লেখার পর কারও না কারও সামনে সেটা গাওয়ার প্রয়োজনও থাকে। কেউ কেউ বলতে পারেন যে ওডিয়েন্সের দরকার নেই কিন্তু আমি সেরকম ভাবি না।
হ্যাঁ আমাদের মেঘদল-এর গানে এক ধরণের কাব্যময়তা আছে, যে কারণে আমজনতা বা সাধারণ শ্রোতা যদি বলি তাহলে সে শ্রেণীর কাছে ‘মেঘদল’ এখনো পৌঁছোতে পারে নি। কিন্তু এটা আমাদের কাম্য নয়। আমি চাই আমাদের পুরান ঢাকায় আমার বাসার পাশের বাসায় নির্বাণ, নেফারতিতি, এসো আমার শহরে গানগুলো বাজুক। ‘কুলীন’ গোষ্ঠির বাইরেও ‘সাধারণ’ মানুষের মাঝে মেঘদল পৌঁছোতে চায়।
কিন্তু সেটার জন্য আমরা কোন কম্প্রোমাইজ করতেও রাজি নই। কম্প্রোমাইজ না করেও কি করে পৌঁছোনো যায় সে চেষ্টা ‘মেঘদল’ করবে।
‘শিরোনামহীন’ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে এ গান শেয়ার দিয়েছেন। আমাদের এখানে এই চর্চাটা কম হয় এক শিল্পী/ব্যান্ড অন্যের গান এভাবে প্রচারের বিষয়টা, এ ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?
এটা ‘মেঘদল’ এর জন্য বিরাট পাওয়া। ‘মেঘদল’ তো আড়ালে থাকা দল। আপনি আমাদের ফেসবুক অফিসিয়াল পেজ দেখলে বুঝবেন, আমরা তেমন এক্টিভ নই, এমনকি আমরা কখনো কোন পোস্ট বুস্ট করিনি। প্রচার খুব কমই করা হয়েছে।
এই গান শিরোনামহীনের প্রাক্তন ভোকাল তুহীন ভাই, আমাদের বন্ধু চিরকুটের সুমি শেয়ার দিয়েছে, এগুলো আমাদের জন্য প্রাপ্তি। এই প্র্যাকটিস যাতে আমরাও করি এবং অন্যরাও করেন সেটা জরুরী। শিল্পীর সাথে শিল্পীর এই যোগাযোগই সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলে। আমরা যদি শিল্পী হয়ে সমসাময়িককালের অন্য শিল্পীর প্রতি মুগ্ধতা জানাতে নাই পারলাম, একটা ইনডিভিজুয়াল চেম্বারে আবদ্ধ হয়ে রইলাম, তাহলে তো হল না।
অনেক ধন্যবাদ দাদা। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক
আপনাকে ও চ্যানেল আই অনলাইনকেও ধন্যবাদ।
নয় বছর পর মেঘদলের নতুন গান: