গত ৩০ জানুয়ারি আবারও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা ও রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ১২৫ নোবেলজয়ীসহ ২৪২ বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। সেই সঙ্গে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে একটি পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসেবে চিঠিটি প্রকাশিত হয়। ড. ইউনূসের এই মামলা নিয়ে তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি পাঠালেন বিশ্ব নেতাদের এই দলটি।
প্রশ্ন হচ্ছে শ্রম আইন লঙ্ঘনকারী, কর ফাঁকিবাজ এবং সাজাপ্রাপ্ত একজন অপরাধীর পক্ষ নিয়ে তারা কেন বারবার চিঠি লিখে স্বাধীন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন? ইউনূসের সাথেই বা তাদের কি এমন সম্পর্ক? আমরা একটু খোঁজ করলেই প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাবে।
আমরা জানি বিশ্বনেতাদের সাথে ইউনূসের দীর্ঘদিনের আঁতাত রয়েছে। ওই নেতাদের পিছনে বিভিন্ন সময়ে অর্থ অথবা শ্রম দিয়ে ইউনূস যেমন পাশে ছিলেন তেমনি তারা ইউনূসের পাশে দাঁড়ানোর নামে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করছেন। এটাও সত্য যে এই বিশ্বনেতাদের সাথে আঁতাত করে অর্থনীতির একজন লোক সুদের ব্যবসা করে গরীব মানুষকে সর্বস্বান্ত করে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেলেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে তার শান্তি পুরস্কারের পেছনে নরওয়ের টেলিনর ও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের লবিং এর নাম খুব বেশি করে এসেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কারটি অনেকাংশে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিবেচনা করা হয় বলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন। অথচ শান্তি পুরস্কার কাদের দেওয়া হবে সে সম্পর্কে স্বয়ং আলফ্রেড নোবেল নিজেই তার উইলে উল্লেখ করে গেছেন। তিনি ১৮৯৫ সালে তার উইলে লিখেছেন যারা শান্তির জন্য মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ ভালো কাজ করে, মানবতাকে সর্বাধিক উপকার করবে, যারা জনগণের ভ্রাতৃত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি বা সেরা কাজ করবে, এছাড়া স্থায়ী সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি কিংবা হ্রাস ও শান্তি কংগ্রেস গঠন ও প্রচারে ভূমিকা রাখবে তাদের জন্য যেন শান্তি পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
ইউনূসের কোন কর্মকাণ্ড কী ওই শ্রেণিতে পড়ে? অর্থনীতির একজন লোক হয়ে শান্তির ওপর নোবেল পাওয়াটাই বিশ্বনেতাদের সাথে ইউনূসের দীর্ঘদিনের আঁতাতের ইঙ্গিত বহন করে।
মজার বিষয় হচ্ছে, বিবৃতির নামে বিশ্বনেতাদের চিঠি মূলত একটি বিজ্ঞাপন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস টাকা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের বিশ্বনেতা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করিয়েছে এবং এখনো করছে। সম্প্রতি গত ৩০ জানুয়ারি মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিবৃতির নামে যে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে তার পিছনে অর্থের যোগান দিয়েছে ইউনূস নিজে। এভাবে অর্থের যোগান দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইউনূস নিজেকে তার অপরাধের সাজা থেকে রক্ষা করতে বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বিশ্বনেতাদের দিয়ে বিবৃতির নামে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে।
কিছুদিন পরপর বিশ্বনেতাদের বিবৃতির নামে এমন সব বিজ্ঞাপন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং হুমকির নামান্তর। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের রয়েছে নিজস্ব সংবিধান যার আলোকে বাংলাদেশ সবসময়ই পরিচালিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আইন সবার জন্য সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় সে যেই হোক। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। অপরাধী যেই হোক বাংলাদেশের আইনে তার সাজা হবে এবং সে নির্দোষ হলে অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে।
ইউনূস দোষী নাকি নির্দোষ তা বিচার করেছে আদালত এবং সে যদি নির্দোষ হতো তাহলে তিনি আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেন। সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে অপরাধী হিসেবে তার সাজা হয়েছে। এর বাহিরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং এই ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের হস্তক্ষেপ কতটুকু ঠিক এটা আমার বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন করে স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন বিচার বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত রায়ের ওপর এমন সরাসরি হস্তক্ষেপ করাটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কাজ, যা বারবার বিশ্বনেতাদের করাটা কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না।
তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে যেসব বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পায়তারা করছে তারা সকলেই একেকজন আইন প্রণেতা। একেকজন আইন প্রণেতা হয়ে আইন ভঙ্গের কথা বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা আমার জানা নেই। তাদের এ ধরনের অপপ্রচেষ্টা অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আইন প্রণেতা হয়ে আইন ভঙ্গের এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রচেষ্টা সরাসরি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ওপর হুমকির সমতুল্য যা কোনোভাবেই বিশ্বনেতাদের করা উচিত হচ্ছে না। বরং তাদের উচিত একেকজন আইন প্রণেতা হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান এবং তার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত বিচার ব্যবস্থার সম্মান পোষণ করা।
তবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক একটা বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতার শুরু থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরোধিতা করছে। বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অপপ্রচেষ্টা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর স্বার্থবিরোধী কোনো কথা বললেই তারা বিভিন্নভাবে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত হানার অপপ্রচেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির সাথে আঁতাত করে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মতো অপরাজনীতি করে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ভিসা নীতির ঘোষণা, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের উস্কানি দিয়ে শৃঙ্খলা নষ্টের অপপ্রচেষ্টা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে স্বাধীন বিচার বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত রায় প্রশ্নবিদ্ধ করা।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ যা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শেষ হবার নয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে এতো প্রচেষ্টার পরেও ব্যর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আবার নতুন করে বাংলাদেশকে চাপে ফেলার অপপ্রচেষ্টা করছে। স্বাধীন দেশের সংবিধানের আলোকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ইউনূসকে নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে সম্প্রতি ২৪২ বিশ্বনেতার চিঠি কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নামান্তর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ কারো ইশারায় স্বাধীন হয়নি।
শহীদের বুকের তাজা রক্তের ফসল আমাদের এই বাংলাদেশ। কারোও রক্তচক্ষুকে বাংলাদেশ পরোয়া করেনা। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে বিবৃতির নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত কোনোভাবেই সহ্য করা হবেনা।
বিশ্বনেতাদের উচিত এসব অপপ্রচেষ্টা বন্ধ করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া। এর বিপরীত কিছু হলে বাংলাদেশের সাহসী জনগণ তা কখনোই মেনে নেবে না।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জনগণ সকল অন্যায়-অত্যাচারে বিরুদ্ধে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে করা সব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের উচিত জবাব সঠিক সময়ে অতীতেও দিয়েছে, বর্তমানেও দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে। এখন ইউনূসের রায় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বনেতাদের উচিত বিবৃতির নামে বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বন্ধ করা। কারণ তাদের এই কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও হুমকির ইঙ্গিত যা কোনোভাবেই বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)