চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মহাকাব্যিক উজ্জ্বলতায় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ৭ মার্চের ভাষণ

৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালির জাতির জন্য আবেগের, দ্রোহের, চেতনার, আকাঙ্ক্ষার এক অপরূপ সম্মিলনের বহি:প্রকাশ। বাঙালির হাজার বছরের অধিকারবঞ্চিত, শোষণের বিরুদ্ধে স্বপ্ন এবং সাথে সাথে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিক্রমায় আবেগময় উচ্চারণে সমৃদ্ধ প্রামাণিক দলিল হিসেবে পরিগণ্য ৭ মার্চের ভাষণটি। ভাষণটির আবেদন অত্যন্ত আবেগতারিত এবং যৌক্তিক যার মাধ্যমে সারা বাংলাকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভাষণটির আবেদন দিন দিন আরও জাজ্বল্যমান হচ্ছে। ভাষণটির মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশগড়ার প্রত্যয়ে আত্মনিয়োগে নিবিষ্ট হতে পারে। হতে পারে নতুন প্রজন্মের এক সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণটি স্বীকৃতি লাভ করেছে। সম্প্রতি ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে World Heritage হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field রচিত “We shall fight on the Beaches: The speeches that inspired History” শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে দেখিয়েছেন বিগত ২৫০০ বছরের মধ্যে স্বাধীনতা পূর্ব ভাষণের মধ্যে প্রায়োগিক ভাবে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই গবেষণা গ্রন্থটিতে বিশ্ব ইতিহাসে প্রভাব বিস্তারকারী রথী মহারথী ৪১ জনের ভাষণ সংবলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কারণ তিনি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের বাস্তবতায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।

‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান
‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান

হারুন-অর-রশিদ সাহেব একটি লেখায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণের যুক্তি দেখিয়েছেন বেশ কয়েকটি যুক্তির মাধ্যমে। সারসংক্ষেপ করলে লেখা যায় এভাবে: প্রথমত; ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালি জাতি মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে আরও অনেক স্বাধীনতাকামী নেতারা ভাষণ দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বাস্তবতা অন্যদের থেকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলো। তাই ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” ভাষণের যথার্থতা প্রমাণে বাঙালি জাতি নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে স্বাধীনতা লাভ করে থাকে।

দ্বিতীয়ত: সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির, লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা, সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের আপোষহীন সংগ্রাম, দেশাত্মবোধে আদিষ্ট হয়ে সকলকে উজ্জীবিত করার মন্ত্রে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা সম্বলিত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বাঙালিকে যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর সেই নির্দেশ বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।” বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন বলেই মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম।

তৃতীয়ত: বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এখনো প্রাণবন্ত এবং যে কোন মুক্তিকামী জাতিকে সফলতা দেখাতে পারে, পারে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সময়ের পরিক্রমায় না থেকে যুগের সাথে সতত বহমান। কেননা, বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ থেকেই নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। শুধু কি বাংলাদেশ, পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মর্মার্থ অনুধাবন করে মুক্তিকামী মানুষ নিজেদের মুক্তি সংগ্রামে কাজে লাগাতে পারছেন। সম্প্রতি ইউনেস্কো প্রধানও বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কোন জাতির জন্য গণ্ডিবদ্ধ নয়, যে কোন জাতি কিংবা গোষ্ঠী তাদের মুক্তির জন্য এ ভাষণ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারে, পেতে পারে মুক্তি সংগ্রামের আলোকময় ছটা।
চতুর্থত: কাব্যিক মহিমা, শব্দশৈলী বিন্যাস ইতিহাস প্রসিদ্ধ ভাষণের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে বিবেচনাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ। কারণ, ভাষণের প্রতি পরতে পরতে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে সাধারণের মধ্যে তিনি একেবারে মিশে যেতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোতে ভাষার মাধুর্যতা, শব্দশৈলীর যথার্থ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিতেও তাই লক্ষ্য করা যায় এবং বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত। বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রতিটি জায়গায় মানুষের সাথে মিশেছিলেন এবং সকলের অবয়ব জেনেই ৭ মার্চের জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেছিলেন।

তবে একদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অন্য সবার থেকে আলাদা ও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কোন লিখিত ড্রাফট ছিলো না। পৃথিবীর ইতিহাসে যে প্রসিদ্ধ ভাষণগুলো রয়েছে সেখানে দেখা যায় নেতারা শুরুতে লিখিত আকারে শুরু করলেও পরবর্তীতে হৃদয় নিংড়ানো উক্তি দিয়ে ভাষণ শেষ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি পুরোটাই হৃদয়ের তাড়নায় প্রস্ফুটিত, সাধারণের আবেগে তাড়িত হয়ে বাংলার মানুষের মনের বাসনাকেই কবির কাব্যিক মহিমায় তুলে ধরেছিলেন রেসকোর্সের ময়দানে। তিনি স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে মর্মস্পর্শী বয়ান তুলে ধরেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের সামনে। আর বাঙালি জাতিও মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে মুখ্য পাঠ হিসেবে ধরে নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাই বলা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। যে ভাষণটিকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা হচ্ছে এবং সর্বশেষ ইউনেস্কোর স্বীকৃতিই তার প্রমাণ বহন করে থাকে।

বর্তমানে ৭ মার্চের ভাষণের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? আমার মনে হয় বর্তমানে ৭ মার্চের ভাষণের গ্রহণযোগ্যতার বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে জানে না। জানে না কেন আমাদের স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়েছিলো? তাছাড়া আমাদের অভিভাবকেরা সে ব্যাপারে যথেষ্ট তাগিদ অনুভব করে না। তাই ছেলেমেয়েরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি শতভাগ জোরের সহিত বলতে পারি, কোন দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়ে পথভ্রষ্ট হতে পারে না। ছেলেমেয়েদের দেশপ্রেমিক হওয়ার পিছনে পরিবারের ভূমিকা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ইতিহাস জানাতে বাবা-মায়ের ভূমিকার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

আর সে ক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণ একটি দালিলিক প্রমাণ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অগ্নিগর্ভ ভাষণের নমুনা খুবই সামান্য। আমরা বাঙালি জাতিরা এ নিয়ে গর্ব করতে পারি। এ ভাষণটিকে নতুন প্রজন্মের সকলের কাছে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অবগত করার মাধ্যমে দেশপ্রেমের স্পৃহা ও অনুরাগ বৃদ্ধি করা যাবে নিঃসন্দেহে। কারণ এ ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালিরা মুক্তি সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। এ ভাষণেই বাঙালিদের শত বছরের শোষণের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছিলো।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)