১৯৬৪ সালে ঢাকা, নারায়নগঞ্জের আদমজীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম ও হিন্দুদের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গার সময়ে দেশব্যাপী আতঙ্কের মোক্ষম মুহূর্তে শেখ মুজিব অনেক হিন্দু পরিবারকে নিজের বাসায় এনে ঠাঁই দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। হিন্দু মেয়ে এবং মহিলাদের থাকা খাওয়ার বিষয়টি নিজ থেকেই তদারকি করতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব অত্যন্ত দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সাথে। পাশাপাশি দাঙ্গার সময়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ মুজিবকে পরামর্শ প্রদান করতেন।
সেই সময়ের একজন জনপ্রিয় নেতার স্ত্রী এবং একজন দায়িত্বশীল মহিলা হিসেবে তিনি যে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তা কর্তব্যের বিবেচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে সমান মর্যাদার আসনে আসীন ছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যেকোন সমস্যায় সমাধানের ভরসাস্থল হিসেবে ফজিলাতুন নেছা মুজিব রাজনৈতিক কর্মী, আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন দূরদর্শিতা এবং নিরপেক্ষতায়।
পরবর্তীতে আদমজী জুট মিলে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গার সময়ে শেখ মুজিব আলোচনার মাধমে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কারণ শেখ মুজিব জানতেন আলোচনার মাধ্যমেই যেকোন সমস্যার সমাধান সম্ভব কোন রকমের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। এসব কাজে ফজিলাতুন নেছা শেখ মুজিবের পাশে ছায়ার মত লেগে ছিলেন, কখনো কোন দিন সামান্য বিরক্তিও প্রকাশ করেন নাই। বাসায় আগত মেহমানদের ও শুভার্থীদের রান্না-বান্না করে খাওয়ানো সহ সকল কাজ নিজেই করতেন ফজিলাতুন নেছা। অতিথি পরায়ণতায় তিনি নিজে যেমন আনন্দিত হতেন ঠিক তেমনি বিপদগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে আমরণ নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
সাংসারিক কাজকর্মে ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন খুবই সহনশীল ও অসীম ধৈর্য্যরে অধিকারী। শত বিপদ এবং অভাব-অনটনের মধ্যেও ছিলেন ধীর স্থির ও অবিচল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষ্য মতে, “মায়ের কাছ থেকে কখনো সংসারের অভাবের কথা শোনা যায়নি। বাজার করার টাকা না থাকলে মা অভিনব কৌশল অবলম্বন করতেন কিন্তু তাতে টাকা না থাকার বিষয়টি কখনোই উঠে আসতো না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুরি রান্না করেছেন, সাথে আচার দিয়ে খেতাম আমরা। মা বলতেন, প্রতিদিন ভাত ভাল লাগে নাকি? আজকে আমরা গরীব খিচুড়ি খাব, এটা খেতে খুব মজা।” সততা এবং বস্তুনিষ্ঠতার অনন্য উদাহরণ ছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি ছেলেমেয়েদের নিজেদের দুর্বলতাকে বুঝতে দিতেন না, এর ফলে তারা মানসিকভাবে প্রশান্তিতে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
১৯৬৬ সালের ভূমিকা
১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে ৬ দফা আন্দোলন শুরুর পূর্বে বঙ্গবন্ধু একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। নেতাকর্মীরা প্রশ্ন করলে শেখ মুজিব বলেন, সকলের কাছ থেকে জোরালো সমর্থন পেলে আন্দোলন শুরু করবো। বঙ্গবন্ধু গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় ছিলেন, সেই গ্রিন সিগন্যালটা ছিল শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। তিনি নেতাকর্মীদের বলেছিলেন এবারের আন্দোলনটা একটু ভিন্ন, আন্দোলনে জয়ী হতে না পারলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে। তাই মুভমেন্ট শুরুর পূর্বে তোমাদের ভাবীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা দরকার। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, আমি কারো বিরোধীতাকে পরোয়া করি না, কিন্তু হাসুর মা বেঁকে বসলে আন্দোলনে নামা কষ্ট হবে। আলোচনার ভিত্তিতে বেগম মুজিবের সাথেই পরামর্শ করে ৬ দফা আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেন।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, “একদিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখি দোতলার সামনের ঘরে বসে বেগম মুজিব তার পানের থালায় পান সাজাচ্ছেন। আমাকে দেখে কৃত্রিম রোষ দেখিয়ে বললেন, কি ভাই, আজকাল যে এদিকে বড় একটা দেখি না। আলফাতেই বসে বুঝি সব পরামর্শ করা হয়। ঐ সময় শেখ মুজিব আলফা ইন্সুরেন্সে চাকরি করতেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মুজিব ভাই কি আপনার সঙ্গে কোনো কথা আলোচনা করেছেন? বেগম মুজিব হেসে ফেললেন। মুখে পান পুরে বললেন, আলোচনা করবেন কী, আমি সব টের পাই। তাকে আমি বলেছি, বুড়াদের নিয়ে আপনি এত ঘাবড়ান কেন? আপনার রয়েছে হাজার হাজার তরুণ কর্মী, ছাত্র, যুবক। তারা আপনার ডাক শুনলে হাসিমুখে আন্দোলনে ঝাঁপ দেবে। আমি শেখ মুজিবের স্ত্রী, এই পরিচয় নিয়ে মরলেও খুশি হব। ইন্সুরেন্স কোম্পানির বড় সাহেবের বিবি পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমি বছরের পর বছর ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্ট করি নাই।”
ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্বামীর প্রতি বিশ্বাসের জায়গাটা ছিল বিশালত্বের ন্যায়, তিনিও চেয়েছিলেন স্বামী দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করুক এবং প্রত্যেকটি কাজেই তিনি নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করতে গিয়ে ৩ মাসের মধ্যে ৮ বার গ্রেপ্তার হন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ফজিলাতুন নেছা এ সময়ে ছয় দফার বাস্তবায়নে জনগণের সদিচ্ছার পরিপত্র প্রদান এবং যথাযথ পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন।
শেখ মুজিবের ৬ দফাকে ৮ দফায় রূপান্তর করার লক্ষ্যে বারংবার সভা আহ্বান করা হয় ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বাড়িতে। দলের সিনিয়র নেতারাও অনেকেই ৮ দফার পক্ষে সমর্থন দিতে গেলেও ফজিলাতুন নেছার সাহসী হস্তক্ষেপের কারণে ৬ দফা ৮ দফা থেকে রক্ষা পায়। বিভিন্ন কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তা অবলম্বন করে ফজিলাতুন নেছা মুজিব আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন, উৎসাহ যোগাতেন। সে সময় হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ফজিলাতুন নেছার পরামর্শ অনুযায়ী। ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “৭ জুনের হরতাল পালনে আমরা মাকে দেখেছি তিনি আমাদেরকে নিয়ে ছোট ফুপুর বাসায় যেতেন, কেননা সেখানে ফ্ল্যাট ছিল ওখানে গিয়ে নিজে পায়ের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলাতেন, বোরকা পরতেন। একটা স্কুটারে করে, আমার মামা ঢাকায় পড়তেন, তাকে নিয়ে ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করতেন, আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ নিজে দিতেন।”
সিদ্ধান্ত সেটি হোক পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক প্রত্যেক জায়গায় ফজিলাতুন নেছা মুজিবের যৌক্তিকতার স্ফূরণ ঘটেছে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিশেষ গুণের কারণে তিনি প্রতিটি জায়গায় সফলকাম হতেন। যে সিদ্ধান্তগুলো তাঁর মতের সাথে মিল রেখে হয়েছে সেগুলোতে সাফল্য এসেছে আবার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার মতকে অগ্রাহ্য করা নেওয়া হয়েছে সেগুলোই বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জন্য বিপদ ডেকে এনেছে।
আন্দোলনের মোক্ষম মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু জেলে, নেতারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দফায় দফায় বৈঠক করছিলেন। কিছুসংখ্যক নেতারা ছিল ৬ দফার পক্ষে আবার অনেকেই ছিল ৮ দফার পক্ষে। ড. মোঃ আসলাম ভূইয়ার প্রত্যক্ষ উপস্থিতির মাধ্যমে জানা যায়, “শ্লোগান হলো ৬ দফার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলবে না, চলবে না। মারমুখী অবস্থা, হট্টগোল। বাঁশের লাঠির ঠোকাঠুকির শব্দ, অবশ্য কারও গায়ে মারা নয়, কিছুটা যেন ভয় দেখানোর জন্য মনে হতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে লাল পেড়ে ডোরা শাড়ি পরে শেখ ফজিলাতুন নেছা আবির্ভূত হলেন সভাকক্ষের ভিতরের দরজার সামনে এবং উঁচু স্বরে বললেন, কী হচ্ছে এখানে? আপনারা কী শুরু করেছেন? আমার বাড়িতে বসে কোন ষড়যন্ত্র করা চলবে না। এখানে কোন মারামারি করা চলবে না। সবাই চুপ হয়ে গেল, নিস্তব্ধ কক্ষ। আমরাও হতবাক।
শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বললেন, আপনাদের নেতা জেলে আছেন। তার অবর্তমানে তার প্রণীত কোন কর্মসূচি আপনারা পরিবর্তন করতে পারেন না। এটা হবে না। এটা হওয়া উচিত নয়। সভা স্থগিত করুন। শেখ মুজিব ৬ দফার জন্য বছরের পর বছর জেলে আছেন আর আপনারা এখানে ৬ দফার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি স্পষ্ট বলেছি, আপনাদের নেতার নির্দেশ ৬ দফা যারা মানবে না তারা দল থেকে চলে যেতে পারেন। তারপরে সকলেই শান্ত হয় এবং পিছন থেকে অনেকেই বলতে থাকে ৮ দফার দালালরা হুশিয়ার, সাবধান।” ফজিলাতুন নেছা ঐ দিন কার্যকরী ভূমিকা না রাখলে ৬ দফার পরিবর্তে ৮ দফা বাস্তবায়ন হয়ে যেতে পারতো।
বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকায় ৬ দফার কর্মসূচিকে জোরালো করার লক্ষ্যে বোরখা পরিহিত অবস্থায় লিফলেট বিতরণ করতেন এবং বিভিন্ন জায়গায় লিফলেটগুলো গচ্ছিত রাখতেন, যেখান থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা সেগুলো সংগ্রহ করে বিতরণ করতেন। গোপনে-চুপিসারে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে আহুত হরতালকে কিভাবে শেখ মুজিবের মুক্তির ফৌজ হিসেবে শোষক শ্রেণির সামনে তুলে ধরা যায় সে বিষয়ে করণীয় ঠিক করতেন।
৬ দফা আন্দোলন চলাকালীন দলের নেতারা অধিকাংশই জেলে ছিলেন। যারা বাইরে ছিলেন তারা হরতালের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। হরতালে কি জনগণকে সম্পৃক্ত করা যাবে এই বিষয়ে নেতারা সন্দিগ্ধ ছিলেন। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা মুজিব নিজে গণসংযোগ করে ৭ জুনের হরতালকে সফল করেন এবং বাঙালির মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬ দফাকে একমাত্র দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। শেখ মুজিবের ঘোষিত ৬ দফা বাঙালির মুক্তির একমাত্র সনদ হিসেবে বাঙালিকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন রেণু।
ফজিলাতুন নেছা মুজিব সারদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন দেশ এবং দলের স্বার্থেই। তিনি প্রয়োজন মাফিক দলের নেতাকর্মীদের দিক-নির্দেশনা দিতেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার থাকাকালীন সময়ে নেতাকর্মীরা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছ থেকে দিক-নির্দেশনা প্রত্যাশা করতেন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে কয়েকটি টিমের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশের খবরাখবর নিয়ে রাখতেন এবং বিপদে-আপদে সামর্থ্য অনুযায়ী দলীয় নেতাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন অব্যাহতভাবে।
বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকাকালীন মফস্বলের নেতারা দিক-নির্দেশনা, পরামর্শ এবং পরবর্তী দলীয় ভূমিকা সম্বন্ধে অবগত হতে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দ্বারস্থ হতেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিস্থিতি বিবেচনা করে কখনো নেতাকর্মীদের আত্মগোপন করে থাকতে বলতেন, আবার কখনো আন্দোলনের রণকৌশল গ্রহণ করে রাস্তায় নামতে বলতেন। অনেক সময় নেতাকর্মীদের সহায়তায় চাঁদা সংগ্রহ করে কারাগারে থাকা নেতাদের মামলা পরিচালনা করতেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফজিলাতুন নেছা মুজিবরা যুগের প্রয়োজনে আসেন আবার হারিয়েও যায় মর্মান্তিকভাবে। কালের বিবর্তনে এবং স্মৃতির মানসপটে এই সকল মানুষরা জায়গা করে নেয় সাধারণের মনে এবং পেয়ে থাকেন তাদের অফুরান ভালবাসা।
চলবে…