একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম সামনের চুলগুলোতে পাক ধরেছে। কিছু পড়তে গেলে বা মোবাইল স্ক্রিনে মুখ দিতেই চোখে ঝাঁপসা লাগছে। চল্লিশের চালশে যাকে বলে। আরও কিছু শারীরিক জটিলতা টের পেলাম। সমবয়সী দুই একজনের সাথে কথা বলতেই তারাও বলল, এমনটি তাদেরও হচ্ছে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল, মেঘে মেঘে বেলা তবে অনেক হয়েছে। জীবন থেকে এতগুলো দিন কিভাবে চলে গেল তবে? ক্যারিয়ার, সন্তান, সংসারের তেল- নুনের হিসেব কষতে কষতেই এক জীবন শেষ হতে চলল।
একটা সময় খেয়াল করলাম, যে আমি অনেকগুলো ফ্যাশনহাউজ ঘুরে ঘুরে শেষে যেটা সবচাইতে ভাল লাগতো সেটাই ফিরতি পথে কিনতাম অথবা একটু অন্যরকম পরার জন্য কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে ডিজাইন করে বানিয়ে নিতাম। সেই আমার আর শপিংয়ের প্রতি আগের ঝোঁক নেই। পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না।
এমনটা কি কেবল আমারই হচ্ছে? না। আশেপাশে ৪০ পেরনো প্রায় অনেকের মধ্যেই এমন সমস্যা। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি সমস্যা তৈরি হতে দেখছি। আর স্যোশাল মিডিয়ায় যেন এই বিষয়টি আমাদের চোখে আরো বেশি পড়ছে। অনেকের মাঝেই কী যেন একটা অসুখী ভাব। নিঃঙ্গতা যেন প্রতিটি মেয়েকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সন্তানরা একটু বড় হয়ে যাওয়া, জীবনসঙ্গীর কাজের প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় আজকাল আর তাদের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ অনেক মেয়েরই।
ঠিক এমন অবস্থায় যখন ভাবতে শুরু করেন, নিজের জীবনের সবটুকুই তাদের পেছনে দিয়ে এখন আপনি একেবারেই একা। যে কাজলটানা চোখ দেখে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতো সেই বরটির আর এখন আপনাকে দেখার সময় কই? যে সন্তানটি আপনার আঁচল টেনে থাকতো আজকাল সেও দূরে দূরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড্ড একা, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস, আর কি করার আছে? এই ভেবেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়া।
৪০ পার করা মানেই কি সব শেষ? আপনি মনে করলেই শেষ, না হয় এটি একটি সংখ্যা মাত্র। আমি দেখেছি বাইরের দেশে ৭০ এর বেশি বয়সী কাপলরাও কি সুন্দর কফিশপে কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা দিচ্ছে। ৮০ বছরের বেশি নর-নারীরাও রাতের খাবারের পর ড্যান্স করতে করতে রাস্তায় নেমে এসেছে। আগে ৩০ এর কোটায় যারা ছিল তাদেরকে তরুন বললেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে তারুণ্যের সময়সীমা এখন ৬৫ বছর পর্যন্ত। আগের চাইতে এখন চিকিৎসাসেবা এবং জীবনমানের উন্নতি হওয়ার কারনে মানুষের মুখেও বয়সের ছাপও দেরি করে পড়ছে।
কিন্তু না, ৪০ এ নিজেকে বুড়ো ভাবার চিন্তা থেকে সরে এসে নিজেকে নতুনভাবে চিনতে জানতে শুরু করলেই জীবন হতে পারে আরো সুন্দর। হতাশা, ব্যর্থতা আর একাকীত্ব থেকে নিজেকে বের করে আনার উদ্যোগটা নিতে হবে নিজেকেই। কিন্তু কিভাবে?
সাধারণ মাথাব্যথা, পেটেব্যথা, পায়ে ব্যথা। আরে ধুরো, এমনি ঠিক হয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কী দরকার! এভাবেই আরও কিছুদিন পার করে দিলেন, একসময় ঠিকও হয়ে গেল। কিন্তু আমরা যদি খেয়াল করি আমাদের বর বা সন্তানদের এমন কিছু হলেই আমরা অস্থির হয়ে পড়ি, দ্রুত ডাক্তার দেখানো এবং চিকিৎসা। তবে নিজেকে এত অবহেলা কেন?
সারাদিন অনেক যত্ন করে রান্নাবান্না করলেন। রাতে ফিরে এসে দেখা গেল আপনার বরের আর খাওয়া হলো না, গুরুত্বপূর্ণ অফিস মিটিংয়ের পর খাবারটা বাইরেই সেরে এসেছেন তিনি। এছাড়াও সবাই খাবারের পর দেখা গেল, আরো খানেকটা রয়ে গেল। ইশ, নষ্ট করব? আজকের পর এ খাবার আর খাওয়া যাবেনা। মা, নানী, দাদীদের বলতে শুনেছি খাবার নষ্ট করলে সংসারের লক্ষ্মী পালায়।
অতএব, অনেক রাতে সেগুলো নষ্ট হবে ভেবে আপনিই খেয়ে নিলেন? এতে হলো কি? আপনার নিজেরই ক্ষতি করলেন। শরীরের ওজন এভাবে দিনের পর দিন বেড়েই চলল। এক্ষেত্রে বলা ভালো, ঘরের ভালমন্দ বা লক্ষ্মী ঢোকানোর দায়িত্বটা আপনার একার নয়। তাই এই বাড়তি জিনিসটুকু নিজের পেটে না ঢুকিয়ে চোখ বুজে ফেলে দিন সরাসরি ডাস্টবিনে।
এখন থেকেই নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। বাড়তি ফ্যাট কমাতে ইয়োগা সহ কিছু এক্সারসাইজ করতে পারেন। আজকাল ইউটিউবেও অনেক টিপস পাওয়া যায়, ঘরে বসেই এগুলো সহজে করে নেয়া যায়।
আমরা জানি কি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দেশে প্রতিবছর দেশে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যায়। এর ৯৮ ভাগের বেশি নারী। বাংলাদেশের নারীরা যতরকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তার মধ্যে সবচাইতে বেশি আছে স্তন ক্যান্সার। আমরা এটাকে প্রথমে পাত্তাই দেই না অথবা লজ্জায় বলি না। তাই যখন ডাক্তারের কাছে যাই তখন একদম শেষ পর্যায়ে। এজন্য নিয়মিত স্তন চেক করানো উচিত। কতদিন পর পর মোমোগ্রাফি অথবা সনোগ্রাফি করানো যায় সে ব্যাপারে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারকে বলা হয় নীরবঘাতক। এর লক্ষণ প্রথমে বুঝতে পারা যায় না। বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে ৮ হাজার ২৬৮ জন নারীর শরীরে জরায়ুর ক্যান্সার শনাক্ত হচ্ছে এবং বছরে ৪ হাজার ৯৭১ জন নারী জরায়ু ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন (তথ্য: ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সী ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার- আইএআরসি)। ৪০-৫০ বছর বয়সী নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং স্তন ক্যান্সারের পর জরায়ু ক্যান্সারেই বেশি আক্রান্ত হন নারীরা। জরায়ু ক্যান্সার চিহ্নিত হতে যেহেতু দীর্ঘ সময় লাগে তাই এর প্রতিরোধে নিয়মিত চেকআপ এবং টিকা নেয়া জরুরি। আর অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে।
মেনোপোজ ৪০ এর পর নারীদের জীবনের অন্য একটি ধাপ। শরীর ও মনে নানা ধরণের পরিবর্তন হতে থাকে এ সময়টাতে। সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সে নারীদের মেনোপোজ হয়ে থাকে। তবে আরও আগে থেকেই এর উপসর্গগুলো দেখা যায়। এসময় মেয়েদের মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মন খারাপ থাকা, শরীরে গরম অনুভূত হওয়া বা রাতে ঘুমের মধ্যে ঘাম হওয়া এ লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এ সময় শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যায়াম করা, ব্যালেন্সড ডায়েট ও ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। অনেকেই মনে করেন মেনোপোজ হলেই জীবনের সব আনন্দ শেষ। বিষয়টি আসলে এমন নয়। এটি নারীদের স্বাভাবিক জীবনচক্রের একটি অধ্যায়। তাই পজিটিভলি নিয়ে জীবনকে সুন্দর করে সাজানো সম্ভব।
শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি এ বয়সে মেয়েরা মানসিক সমস্যাটাও প্রকট হয়। হতাশা, ডিপ্রেশন, মুডসুইং এসব চলতেই থাকে। কখনও কখনও এটা এতটাই গভীর হয় যে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। তাই মানসিক এসব সমস্যাকেও ছোট করে দেখা উচিত নয়। সাইকোলজিস্টের পরামর্শে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করা যেতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে বন্ধু নির্বাচনে সাবধানী হতে হবে। জীবন যখন পানসে হয়ে যাচ্ছে, আশপাশের মানুষগুলোও দূরে সরে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় মেসেঞ্জারে টুংটাং আওয়াজ -‘বাহ আপনার চোখ দুটো তো খুব সুন্দর’। অথবা ‘কী সুন্দর মায়াবী হাসি’। জীবনে কতদিন পর শুনলেন এমন কথা, এমনটা ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে দু’ ফোটা পানিও গড়িয়ে পড়তে পারে। তারপর আরও কথা, মন দেয়া নেয়া। এরপর অপরপ্রান্তের মানুষটি হঠাৎ একদিন উধাও। বিষিয়ে যাওয়া জীবনে যে আনন্দের ঝিলিক দেখতে শুরু করেছিলেন তাতে যেন আগুনে ঘি ঢালার মতোই অবস্থা হলো। জীবনটা আরও বিষিয়ে উঠতে শুরু করল। আমি বলছি না বন্ধু বানাবেন না, তবে জেনে বুঝে এ পথে পা বাড়ানোই শ্রেয়। কিন্তু মন কি আর বাঁধ মানে? তাই দায়িত্বটা একেবারেই নিজেকে নিতে হবে, আগুনে ঝাঁপ দিবেন নাকি প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়বেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন তো নিজেকে চিনতে পারেন কিনা? চোখের নীচে কালো দাগ, মুখে মেছতার দাগ, বলিরেখা? আহা এই মুখ দেখে একসময় কতজনই না প্রেমে পড়েছে…! কষ্ট লাগলেও আজই চলে যান কোন পার্লারে। নিজের ত্বকের যত্ন নিন। জম্পেশ করে একটা শ্যাম্পু করে নিন আর পারলে মাসে একটা স্পা নিয়ে নিন, দেখবেন নিজেকে কতটা ফুরফুরে ও ফ্রেশ লাগে।
আপনি যখন এগুলো করতে শুরু করে দেবেন দেখবেন এতদিন ধরে আপনার রূপের প্রশংসা না করা বরটিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে। আপনিও মুচকি হেসে সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজের জন্য পরিপাটি করে সেজে, হাইহিল পরে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যান কোন কফিশপে। ডেকে নিতে পারেন সমমনা কিছু বন্ধুদের। না পেলে একাই নিজেকে নিজে সময় দিন। মনে রাখতে হবে জীবনের অনেকটা পথই এখনও বাকি, তাই জীবনকে কেঁদে না ভাসিয়ে হেসেখেলে উড়িয়ে দিন তবে সেটা যেন হয় পজিটিভলি। খারাপভাবে যে সুখ সেটা দু’দিনের। তাই আনন্দগুলো যেন হয় নির্মল ও সুন্দর।