২৫ মার্চ দিবাগত রাত। ১৯৭১ সাল। থমথমে তৎকালীন ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ। ঘটনাবহুল সেই দিনগুলোতে বাঙালির একটাই চাওয়া, স্বাধীনতা। এটা কি তাদের অপরাধ? হ্যাঁ, পাকিস্তানি বর্বর শাসক-শোষক গোষ্ঠির কাছে এটাই একমাত্র ‘অপরাধ’। তাই তারা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর চালালো বিশ্ব ইতিহাসের ভয়াবহ ও নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ। এমন গণহত্যায় স্তম্ভিত হয়ে গেল পুরো দেশ, সমগ্র বিশ্ব।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হায়েনার মতো যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর, নির্বিচারে যেভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের মানুষকে, তাতে এত কঠিন, দুরুহ ও ভয়াল অভিজ্ঞতার পর পুরোপুরি দমে যাওয়ার কথা ছিল বাঙালি জাতির। কিন্তু তীব্র কষ্ট থেকে অনুপ্রেরণা নিতেই শিখেছে বাঙালিরা। তারা থেমে যায়নি। বর্বর সামরিক শক্তির ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেয়নি। বরং তাদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর যে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাবে, তা যেন ছিল স্পষ্ট। এরপর শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে দেখতে পাই স্বাধীন বাংলাদেশ।
তবে সংগ্রামের এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার ভয়ঙ্কর রূপও দেখেছে বাংলাদেশ। নিরীহ বাঙালির ওপর এমন বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের পর অধিকাংশ বাঙালি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিলেও গুটিকয়েক নামধারী বাঙালি ধর্মের নামে তাদের সমর্থন করেছে। কিন্তু কোনো ধর্ম কি স্বজাতির ওপর এমন গণহত্যা চালানো দেখলেও কাউকে কি গণহত্যাকারীদের সমর্থন করার অধিকার দেয়? দেয় না। স্বজাতি তো দূরের কথা, কোনো মানুষ বা যেকোন প্রাণীর ওপর অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না ধর্ম। ইসলামে বরং কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যার বিধান রয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে তখনকার ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই গণহত্যাকে ‘ইসলাম রক্ষা’র প্রলেপ দিয়ে বৈধতা দিতে চেয়েছিল? বরং মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সংগ্রামই ন্যায়সঙ্গত ছিল।
এছাড়া পাকিস্তানি হায়েনারা যেভাবে সেই কালরাতে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বাঙালির ওপর, তা কি কোনভাবেই ধর্মসম্মত? তারা যে ইসলামের কথা বলে একে ধর্মীয় রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের আণ্ডাবাচ্চারা এখনও করছে; সেই ইসলাম কি কখনো কোনো যুদ্ধে প্রথমে আঘাত করেছিল? করেনি। বরং নিজেদের ওপর আঘাত আসলে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধে জড়িয়েছে বলেই ইতিহাসে প্রতীয়মাণ। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষার জন্য। গণহত্যার হাত থেকে স্বজাতিকে বাঁচানো, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা এবং দেশ মাতৃকাকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। অথচ সেই ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে মাসের পর মাস নির্বিচারে হত্যা করে গেছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা। এখনও তাদের আণ্ডাবাচ্চারা ধর্মের অপব্যাখ্যাকেই সঠিক মনে করে! এজন্যই স্বাধীনতার কয়েক যুগ পরও ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ প্ল্যাকার্ড দেখতে হয়েছে খেলার মাঠে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নারকীয় গণহত্যার পরও কোনো বিবেকবান মানুষ, বিশেষ করে যার বিন্দুমাত্র বিবেক রয়েছে, সে কখনোই গণহত্যাকারীদের সমর্থন করতে পারে না। সাফাই গাইতে পারে না। কিন্তু ইতিহাস বলছে: ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধের নামে আলবদর নামধারী বাহিনী তৈরি করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হয়েছে। গণহত্যাকারীদের পক্ষ নিয়ে তারাও ধর্মের নামে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এদেরও করেনি।
পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের চালানো নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে যারা কথিত ধর্মযুদ্ধ বলে মনে করে, তাদের জন্য বিএনপিরই একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের একটি লেখা প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার ‘সৈনিক জীবন- গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ বইয়ে লিখেছেন: ‘…অফিসার মেসে ট্যাক্স ফ্রি সুরা স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়, এ কারণেই অফিসারকুল মদ্যপানে অভ্যস্ত। পানাভ্যাস না থাকলে অফিসারকে কেউ কেউ আনস্মার্ট ভাবেন ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তানে।’ এতেই বুঝা যায়, ইসলামিক রিপাবলিক এর অখণ্ডতার নামে গণহত্যাকে জায়েজ করতে তারা ধর্মের নাম ব্যবহার করেছে। নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখে বাংলাদেশকে তারা শোষণ করতে চেয়েছিল ধর্মের জিগির তুলে। কিন্তু বাঙালি তাদের এই কপটতা বুঝে গিয়েছিল, তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি।
সেই কালরাতের বর্ণনা দিয়েছেন মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন। ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন: সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হল যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।
এরপরও কিভাবে সেই গণহত্যাকারীদের পক্ষ নিয়েছিল এদেশীয় কিছু কথিত বাঙালি। শুধু পক্ষ নেয়া নয়, বরং হায়েনাদের পক্ষে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিল। ধর্মের নামে বুলি আওড়ালেও তারা পরাজিত হওয়ার পরও যুগ যুগ ধরে সেই অপব্যাখ্যা দিয়ে গেছে! এখন সময় এসেছে এসব প্রশ্ন করার। এখনকার তরুণরা অনেক বেশি সচেতন। যারা এখনও মনে করে এটা ধর্মের বিষয় ছিল, সেটা যদি একজনও হয়; সে বা তারা নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করবে বলেই আশা করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা ধর্মের সেই অপব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
তবে গৌরবের বিষয় হলো: কিছু স্বার্থবাজ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে বেড়ালেও বাঙালি তাতে কর্ণপাত করেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চের কালরাতে নির্মম গণহত্যা হলেও এতে থমকে যায়নি বাঙালি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে গণহত্যার পরই বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করেন। বিদ্রোহের খবর পেয়ে শুরুতেই হোঁচট খায় পাকিস্তানিরা। এতে গণহত্যা ঢাকার বাইরে বেশি বিস্তৃত হতে পারেনি। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ আরও উজ্জীবিত হয়। সাহস পায়। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়ে বিদ্রোহীরাও ভরসা পায়। এরপর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় তুমুল গতি পায় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এত গৌরবজ্জল ইতিহাস পৃথিবীর কোনো জাতির নেই। এরপরও কিছু মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে। এর কারণ, প্রকৃত ইতিহাস না জানা। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে একটি প্রজন্মকে পাকিস্তানপ্রেমি বানানো হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রকৃত ইতিহাস তাদের কাছে তুলে ধরার বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে বিকৃত ইতিহাসের শিকার তরুণ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। এখন মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগ। প্রকৃত তথ্য খুঁজে নিতে হবে। একটি অপশক্তির সাথে বলতে গেলে অসম যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনা হলো। যুদ্ধটা কি এমনি এমনি হয়েছিল? কেন নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হায়েনারা এমন বর্বরতম গণহত্যা চালালো? কী দোষ ছিল বাঙালির? নিজের বিবেকের কাছে এসব প্রশ্ন করতে হবে। তাহলে আর কেউ তাদেরকে অপব্যাখ্যা দিয়ে যুগের পর যুগ অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখতে পারবে না।
২৫ মার্চের কালরাতে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যার এই ক্ষণে, গণহত্যা দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)