২০০৪ থেকে ২০১৬-একযুগ পেরিয়েও বিচারের আলো দেখেনি ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা। শুরুতে জজ মিয়া নাটক; রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বারবার মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্থ করা। সবশেষে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারও পুনঃতদন্ত শুরু- সাড়ে তিন বছর বাদে পুলিশের বিলম্বিত চার্জশিট। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে সবখানেই। শেষ সাত বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে ওই দিন হামলার শিকার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এমনকি দলটির পক্ষ থেকে চার্জশিট ভুক্ত সকল আসামীর সরাসরি জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে বহুবার। তবু অদৃশ্য বন্ধনে আটকে আছে মামলার বিচারের রায়।
ওই দিনের নৃশংস হামলার বর্ণনা দিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত রায় না হওয়াকে হতাশাজনক বললেও-‘দ্রুত বিচারের চেয়ে সঠিক বিচার কাম্য’ বলে মনে করছেন ওই দিন স্পটে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাবেক ইউএনবি রিপোর্টার ফরিদ আহমেদ। তবে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য বিএনপি আমলের বিভ্রান্তিকর তদন্ত প্রতিবেদনকে দায়ী করছেন ৭১ টেলিভিশনের চিফ নিউজ এডিটর বায়েজিদ মিল্কি।
ওই দিন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশ কাভারের দায়িত্বে থাকা ইউএনবির রিপোর্টার ফরিদ আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বিভৎসতার বর্ণনা করতে গিয়ে জানান: আমিসহ কয়েকজন রিপোর্টার ওই দিন রমনা ভবনের সামনে বসে ছিলাম। শুরুতে আমরা বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। এরপরই সাধারণ মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আমি দৌড়ে রমনা ভবনের দোতলায় উঠে যায়। তবে এটা যে গ্রেনেড ছিলো আমরা তখনও বুঝতে পারিনি। কেননা, এর আগে গ্রেনেডের সঙ্গে আমাদের তেমন একটা পরিচিতি ছিলাম না। আমাদের ধারণা ছিলো ককটেল কিংবা সাধারণ কোনো বোমা হবে!
আমি যখন ক্রল করে দোতলার বারান্দার দিকে গেলাম; সেখান থেকে পুরো সমাবেশ স্থলটিই দেখা যাচ্ছিলো। বাইরে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠলো বিভৎসতা। চারিদিকে মানুষের শরীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। প্রথমে বোমা হামলা চালানো হলেও শেষ দিকে কিছু গান শট ছিলো। বন্দুক-পিস্তল ব্যবহার করে গুলি করা হচ্ছিলো। সঠিক ভাবে বলতে না পারলেও হামলার প্রথম দেড় মিনিট শুধু বোমা চার্জ করা হয়। এরপরই শুরু হয় গুলি বর্ষণ। অন্তত আড়াই মিনিটের মতো স্থায়ী ছিলো হামলাটি।
বায়েজিদ মিল্কিও জানাচ্ছিলেন ঠিক এমনটিই; ওই দিন সমাবেশস্থলে ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছিলো না জানিয়ে তিনি বলেন: আমরা রমনা ভবনের দোতলা থেকে ফুটেজ নিচ্ছিলাম। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রায় শেষ, ঠিক তখনই বোমা হামলা শুরু হয়। আমি এবং আমার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাপার্সন প্রথমে মনে করেছিলাম, হয় ককটেল কিংবা দেশীয় কোনও বোমার বিস্ফোরণ। কিন্তু সময় যেতেই আমরা আঁচ করতে পারলাম বোমার শব্দটা কিছুটা ভারি হয়ে আসছে। পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি দ্রুত ফোন করে অফিসকে জানাই।
তবে ফরিদ আহমেদের সঙ্গে তিনিও একমত। দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী আরও আগেই হওয়া উচিৎ ছিলো বহুল আলোচিত এ মামলার বিচার কাজ। তবে এক্ষেত্রে বাধা বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে দেওয়া বিভ্রান্তিকর তদন্ত প্রতিবেদন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মামলার প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউল রহমানে সঙ্গে আমার গত বছর কথা হয়েছিলো। তখন যেটা বলেছিলেন: বিএনপি আমলে যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিলো। সেটা অনুযায়ী বিচারকাজ শুরু করেছিলেন বিজ্ঞ আদালত। পরে আবারও একটা তদন্ত রিপোর্ট যখন আসলো-তখন সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হলো। এটাই বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার মূল কারণ। তবে অতিসত্ত্বর মামলায় রায় আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ফরিদ আহমেদ বলেন: বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। এখানে মামলার জট আছে। আবার তদন্ত সক্ষমতারও একটা ব্যাপার রয়েছে। বিএনপির আমলে এই মামলাকে বার বার বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে। তারপরও যখন হামলায় জড়িতদের অধিকাংশই গ্রেফতার আছেন, তাই মামলার বিচার কাজ আরও আগেই শেষ হতে পারতো।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার ওপর হামলা কিন্তু ওইটাই প্রথম ঘটনা না। এর আগেও বরিশালে শেখ হাসিনার ওপর হামলা হয়েছিল। কিন্তু এটা খুবই হতাশার চিত্র যে, বিগত সাত বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তারপরেও বিচারে ধীরগতি। যারা এ ঘটনার পেছনে ‘মাষ্টারমাইন্ড’ তাদেরকে কতোটুকু কাঠগড়ায় আনা গেছে? আরেকটা ব্যাপার আমরা দেখেছি বিএনপির সময় যারা তদন্তকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে, তাদের কতোটুকু বিচারে আওতায় আনা গেছে। কেননা, আমাদের তদন্তকারী সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে এমনিতে প্রশ্ন আছে। তার ওপর যদি তদন্তকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয় তার হতাশাজনক। এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিচারের বিষয়ে আশাবাদী ফরিদ আহমেদ বলেন, অবশ্য এক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের চেয়ে সঠিক বিচার কাম্য বলে আমি মনে করি। আমাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমি আমার জায়গা থেকে মনে কারি এ বিচারে জন্য যদি আমাদের আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয় সে সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। কিন্তু যারা ব্যাপারটা ঘটিয়েছেন যারা পেছন থেকে কলকঠি নেড়েছেন তাদের সকলের যেনো বিচার হয়। প্রত্যেকে যেনো বিচারের আওতায় আনা হয়।
বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান।
মেয়র হানিফের মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্পিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যান।