তারেক রহমানের নির্দেশনায় জাতীয় সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে দল ও জোটের অনেক নেতা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের শরিক নেতারাও বিএনপির সংসদে যাওয়ার এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না। এ শপথকে কেন্দ্র করে ভেঙ্গে যাচ্ছে ২০ দল, গণফোরাম এবং ঐক্যফ্রন্ট। ইতিমধ্যে ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। দলটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০ দল ত্যাগের কারণগুলোও উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি বলেন, বিজেপি ১৯৯৯ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট এবং পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোটে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমশই স্থবির হয়ে পড়ে। বিরোধীদলীয় রাজনীতি অতিমাত্রায় ঐক্যফ্রন্টমুখী হওয়ায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরবর্তীতে সরকারের সঙ্গে সংলাপসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ২০ দলীয় জোটের বিএনপি ছাড়া অন্য কোনও দলের সম্পৃক্ততা ছিল না।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটিতে আরও বলা হয়, কেবল মাত্র সংহতি এবং সহমত পোষণের জন্য ২০ দলীয় জোটের সভা ডাকা হতো। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ২০ দলীয় জোটের সবার সম্মতিক্রমে এই নির্বাচন প্রত্যাখান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে প্রথমে ঐক্যফ্রন্টের দুজন এবং বিএনপির সম্মতিতে চারজন সংসদ সদস্য শপথ নেয়ায় দেশবাসীর মতো বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপিও অবাক এবং হতবাক। শপথ নেয়ার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিএনপি ছাড়া ২০ দলের অন্য কোনও দলের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আন্দালিভ রহমান পার্থ আরও বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি মনে করে, এই শপথের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। যে কারণে ২০ দলীয় জোটের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিজেপি ২০ দলীয় জোটের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসছে।
২০ দল ছাড়া প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার পার্থ গণমাধ্যমকে বলেন, নিজেদের সম্মান বিকিয়ে দিয়ে অন্যদের সঙ্গে জোট করার মনমানসিকতা আমার নেই। একই অভিমত বিএনপি ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অপর শরিক দলগুলোরও। এখন বিজেপি তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্য দলগুলো এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় তা তাদের বিষয়৷
এদিকে ২০ দলীয় জোটের আরেক শরীক লেবার পার্টিও বিএনপিকে কর্মসূচির দাবিতে ২৩ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এর ব্যতয় হলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। তিনি বলেন, আমরা বিএনপিকে ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া এবং কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কর্মসূচি দিতে আগামী ২৩ মে পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, ২৪ মে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত বিএনপিকে জানিয়ে দেব। ইরান আরও বলেন, শুধু আমার দল নয়, আমি যদি এই ২০ দলীয় জোটে না থাকি অন্তত ৫টি দল বেরিয়ে যাবে। উল্লেখ্য এর আগেও একবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন লেবার পার্টির এই নেতা। ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ২০ দলীয় জোটে অন্তর্ভূক্ত করলে জোট ত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন তিনি৷
৪ দল হয়ে ১৮ দল ও ১৮ দল হতে ২০ দল হয়ে ওঠা জোটটি কি তবে সংকুচিত হয়ে আসছে?বিজেপি বেরিয়ে গেলে হয় ১৯ দল, ইরানের বক্তব্য অনুযায়ী আরও ৫টি দল বেরিয়ে গেলে হয় ১৪ দল৷ তবে কি ২০ দলও ১৪ দল হতে যাচ্ছে? কি ঘটতে চলেছে ২০ দলে? মিছিল, মিটিং, সভা সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ কিছুই করতে পারছেনা এই জোটটি৷ সহিংস হরতাল নয় অহিংস হরতাল কি ডাকতে পারতোনা তারা? ভোটদানে আগ্রহ হারানো মানুষদের অহিংস হরতালমুখী করা কি খুব বেশি কঠিন কাজ ছিল? আসলে ২০ দল কি চায় তাদের নৈতিক অবস্থান কি সেটাই তারা পরিস্কার করতে পারছেনা মানুষের কাছে৷কেন তারা এ সরকারকে অবৈধ বলল আবার কেন এই সরকারের অধীনেই তারা নির্বাচনে গেল? কেন তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করল আবার সে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সাংসদদের সংসদে যেতে দিল? জাতীয় সংসদে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ২০ দলের মতো ঐক্যফ্রন্টেও দেখা দিয়েছে ভাঙনের লক্ষণ৷
ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। দলীয় কার্যালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে ৮ জুনের মধ্যে ঐকফ্রন্ট ত্যাগের আল্টিমেটাম দেন তিনি। জোটের নির্বাচিত ৮ জনের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার প্রতিবাদে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। কাদের সিদ্দিকী বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের এই অসঙ্গতি দূর না করলে জোট ত্যাগ করা হবে। উল্লেখ্য, গত ৫ই নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলো কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ৷ এক বৎসর যেতে না যেতেই ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার হুমকি দিলেন৷ আসলে কি ঘটতে চলল সরকার বিরোধী এই মোর্চাগুলোতে? ভাঙনের সুর ২০ দলে, ঐক্যফ্রন্টে ও গণফোরামে৷ গণফোরাম নেতাদের সংসদে যাওয়া নিয়ে সেখানেও বাজছে ভাঙনের সুর৷ ২০ দল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তগুলো এর নেতারা নেয় নাকি বিদেশি ফেরারী তারেক রহমান নেয়? দলে ও জোটে যদি মনোনয়ন দেয় তারেক রহমান, সিদ্ধান্ত দেয় তারেক রহমান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় চেয়ারম্যান তাহলে দল ও জোটের আর কাজ কী থাকে? ২০ দল, বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গণতন্ত্রের কথা বলছে কিন্তু নিজেদের মধ্যে কি কোন গণতন্ত্র আছে?
দল ও জোটে গণতন্ত্র না থাকলে একদিন না একদিন দুর্গতি অনিবার্য৷ যেখানে প্রয়োজন সরকার বিরোধী ইস্পাত দৃঢ় ঐক্যের সেখানে আজ দেখা দিল পাথর ফাটা অনৈক্য৷ পাথর ফাটলে কি তা স্কচটেপ দিয়ে কিংবা আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো যায়? কেউই আর জোটে থেকে দ্বন্দ্ব করতে চাইছেনা তারা জোট ত্যাগ করতে চাইছে৷ তাও আবার আল্টিমেটাম দিয়ে৷ তাদের দেয়া আল্টিমেটাম অনুযায়ী কাজ না হলে তারা জোট ত্যাগ করে কি করবে? তারা কি এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতেই থাকবে? এতে লাভটা কি সরকারের হবেনা? সরকার পন্থীরা কি তখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলবেনা এই দেখো এরাই বুঝি গণতন্ত্র উদ্ধার করবে!বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে কঠিন করে তোলার কথা বলেছিলেন৷ তার এই কঠিন তত্ত্ব কি নিজ পুত্রের মধ্য দিয়ে নিজের দলেই দেখা দিচ্ছেনা? বড় কঠিন হয়ে উঠলো না কি ২০ দল, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের টিকে থাকা? ব্যারিস্টার পার্থ বলছেন, বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই ২০ দলীয় শরীকদের কোন ভূমিকা নেই৷ সব সিদ্ধান্ত বিএনপির নেয়া৷ লেবার পার্টি বিএনপির চেয়ারপার্সন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে বিএনপিকে? বিএনপির চেয়ারপার্সনের মুক্তির কর্মসূচিটিও আল্টিমেটাম দিয়ে নিতে হচ্ছে তাও খোদ বিএনপির কাছেই! তবে কি তারেক রহমান মাতৃমুক্তি চাননা?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আবার বলছেন, বিএনপিকে ভাঙার জন্য নানা প্রকার অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আপনারা কোনো ভুয়া খবরে, গুজবে কান দেবেন না। বিএনপি তারেক রহমানের নির্দেশে ঐক্যবদ্ধ আছে।
আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশ থেকে আমাদের পরিচালনা করছেন। তিনি আমাদের যে নির্দেশনা দেবেন আমরা সেই নির্দেশনায় ঐক্যবদ্ধ থাকব। যদি একথা সত্যি হয় তবে তিনি কেন তারেক রহমানের নির্দেশে সংসদে শপথ নিতে গেলেন না? কৌশল অতি কৌশল হয়ে কি রাজনীতির মাঠে তাদের অতি চালাকের গলায় দড়ি উঠে যাওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে না? বিদেশি পলাতক থেকে কী খেলা খেলছেন তারেক রহমান? দলের নীতি নির্ধারকদের সবাই শপথ নেয়ার বিপক্ষে ছিলেন৷স্থায়ী কমিটির উপস্থিত সকলেই শপথ নেয়ার বিপক্ষে ছিলেন? কিন্তু উপস্থিত সদস্যদের মতামতের কোন মূল্য নেই৷ মূল্য অনুপস্থিত ফেরারী তারেক রহমানের৷ বিরোধী দলে থেকেই তারেক রহমান যেরকম স্বৈরাচারী ভূমিকা দেখালেন ক্ষমতায় গেলে কি দেখাবেন তা বুঝতে কি এতবেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন আছে? এসব কর্মকাণ্ডে দেশবাসীর সামনে তাদের চরিত্রের রূপটা কি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলোনা?এই স্পষ্টতার দায়ও তাদের নিজের৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)