একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কিছু জিনিসের ওপর অনেক সময় হাত থাকে না। এর বড় প্রমাণ হল আমাদের নাম। সাধারণত পরিবারের মুরব্বি, ধর্মীয় গুরুজন, সংসারের প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা বাবা-মায়ের দেয়া নামেই সমাজের দশজনের কাছে আমরা পরিচিত হই। একসময় সেই নাম সরকারের খাতায় উঠে যায়। তারপর থেকে স্কুল কলেজের নথিতে নিবন্ধ হতে থাকে। ধীরে ধীরে আমাদের নাম জেনে যায় দেশ-বিদেশের বহু লোক। জন্মক্ষণে পাওয়া নাম পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করে কেউ কেউ হয়তো অন্য নামে পরিচিত হয়েছেন কিংবা আধুনিক রূপ দান করেছেন। কিন্তু সংখ্যায় তারা খুবই অল্প।
মাতৃভাষা থেকে নামের ইংরেজি বানান করতে গিয়ে অনেকে ভুল করে বসেন। তারপর সেই ভুল নাম নিয়ে চলতে হয় সারাটি জীবন। এছাড়াও আন্দাজের উপর শরীরের উচ্চতা বসিয়ে দেয়াও কারো কারো জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চতা মাপার মাপকাঠি কজনের বাসায় থাকে বলুন? তাই পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি কিংবা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি নিয়েই আমাদের ঘুরে বেড়াতে হয় দেশে বিদেশে। এরপরও যারা সঠিক নাম, উচ্চতা বা জন্মতারিখ নিয়ে সন্তুষ্ট তারা খুবই ভাগ্যবান।
অখণ্ড বাংলায় ১৮৭৩ সালের ব্রিটিশ সরকার জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন জারী করেছিল। কিন্তু সেই আইনের কার্যকারিতা তেমন ছিল না। একটা বড় ঝড়ের সময় জন্ম হয়েছিল কিংবা হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গার পর জন্ম নিয়েছি এমন কথা আগে খুব শোনা যেত। একসময় বাংলাদেশে জন্ম তারিখ নির্ধারণ হতো শলাপরামর্শ করে। ত্রিশ-চল্লিশ দশকে খুব কম লোকেরই জন্মতারিখ ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত সার্টিফিকেট দ্বারা চিহ্নিত। একই ধারা পঞ্চাশ ষাটের দিকেও দেখা যায়। এরপর থেকে মোটামুটি সরকারি নথিপত্র কিংবা মেডিকেল সনদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের উপর ভিত্তি করে রচিত ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর অধীনে বাংলাদেশে এখন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভালোই হয়েছে, না হলে বাংলাদেশে ১লা জানুয়ারি জন্মোৎসব দিন বলে একটি মিষ্টি খাবার উৎসব দাঁড়িয়ে গেলে অবাক হবার কিছু ছিল না। কেন? সে কথায় আসছি।
একসময় ঢাকা শহরেও দাই কিংবা অভিজ্ঞ মহিলাদের সাহায্য নিয়ে সন্তান প্রসব করানো হতো। তাই জন্ম নিবন্ধন কিংবা সার্টিফিকেট নেবার প্রচলন না থাকারই কথা। আমাদের অনেকেই সেই দলেরই একজন যাদের জন্ম তারিখ পরিবারের ডাইরিতে লেখা থাকলেও স্কুল বোর্ডের রেজিস্ট্রেশনের সময় সেটা পরিবর্তন করা হয়। এই মহান কাজটি সাধারণত করতেন স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষকেরা।
আমি একজন শিক্ষককে জানতাম যিনি ছিলেন মানুষবেশী বাঘ। স্কুলের গর্জন হুঙ্কার বলতে যা কিছু ছিল সেটা ছিল সেই ‘লতিফ স্যারের’ কণ্ঠ। একটা ঘটনা বলি। সম্ভবত স্কুলের সেমি-এনুয়্যাল পরীক্ষা হচ্ছিল। ক্লাসের একটি ছেলে নকল করতে গিয়ে লতিফ স্যারের কাছে ধরা পরে যায়। আর যায় কোথায়! ছেলেটির গালে মুখে প্রথমে দু’হাত চালালেন স্যার। তারপর একজনকে দিয়ে অফিস থেকে বিশেষ বেত আনালেন। বেচারা ততক্ষণে ফ্লোরে শুয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। বেত দিয়ে আঘাত করার কিছুক্ষণ পর ছাত্রদের মুখে পানি ছিটে আসল। পানি আসছে কোথা থেকে জিজ্ঞেস করতেই পাশে বসা ছেলেটি নাক চেপে ধরল। বুঝা গেল লতিফ স্যারের বেতের আঘাতে ছেলেটি দুটি কাজই করে দিয়েছে। এলো ঢাকা স্কুল বোর্ড রেজিস্ট্রেশনের সময়। পাকিস্তান আমলে ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার আগে পরে কোন এক সময় এই রেজিস্ট্রেশন করানো হতো। লতিফ স্যার একটা টেবিল নিয়ে বসে আছেন আর ছাত্ররা লাইন ধরে অপেক্ষা করছে নাম রেজিস্ট্রেশনের জন্য। লাইন যত ছোট হয় ছেলেদের উত্তেজনা ততো বাড়তে থাকে। লতিফ স্যার টেবিলের একগাদা কাগজের দিকে ঝুঁকে জন্ম তারিখ জিজ্ঞেস করছিলেন। ছেলেদের কেউ বলতে পেরেছিল কেউ পারে নি তাদের জন্ম তারিখ।
কিন্তু লতিফ স্যার লিখে যাচ্ছেন ১ জানুয়ারি না হয় ৩১ ডিসেম্বর। একজন তার সঠিক জন্ম তারিখটি বলল। তিনি কিছু শুনলেন বলে মনে হল না। জন্ম তারিখের জায়গাতে লিখলেন ১লা জানুয়ারি। ছেলেটি বলল স্যার আমার জন্মতারিখ ১লা জানুয়ারি না। এবার তিনি অন্য ছাত্রদের মত ধমক দিয়ে বললেন ‘আমার থেকে বেশি বুঝো? ১লা জানুয়ারি জন্ম তারিখ লিখলে একটা বছর বেশি কাজ করতে পারবে গাধা। বছর শেষ না হলে রিটায়ারমেন্ট নিতে হবে না। চাকুরীর জন্য পুরো ৩৬৫ দিন ভোগ করতে পারবে। মনে রাখবে তোমার জন্মদিন ১লা জানুয়ারি। ঠিক আছে’? সেই থেকে ছেলেটির জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি। স্কুল সার্টিফিকেট থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে পাসপোর্টতে বাসে যায় লতিফ স্যারের দেয়া তার ডি ও বি অথবা ডেথ অব বার্থ। মজার ব্যাপার হল বিয়ের পর সে জানলো তার স্ত্রীর জন্ম তারিখও ১ জানুয়ারি। এটাও হয়তো অন্য কোন লতিফ স্যারের শুভ চিন্তা। এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের একাধিক সদস্যদের জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি। একবার ভেবে দেখুনতো বিমান বোঝাই বাংলাদেশীরা যখন কোন দেশের বিমানবন্দরের গিয়ে নামে তখন কি হাসির কাণ্ডটাই না হয়।
নাম কিংবা জন্মতারিখ পরিবর্তনের এই পদ্ধতি কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা চিনতে সাহায্য করতে পারে। একটা জাতি কতটা পিছিয়ে অথবা আধুনিকায়নের মাপকাঠিতে কোথায় অবস্থান করছে সেটা হয়তো জন্ম নিবন্ধন ও নামকরণের পদ্ধতি দেখেও আন্দাজ করা সম্ভব। যারা সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন ও পরিবর্তন জানতে চান তারা এই মাপকাঠি ব্যবহার করেন কি না জানি না। করলে কিন্তু মন্দ হয় না।
জেনে অবাক হবেন শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই ১লা জানুয়ারি একটি জনপ্রিয় জন্মতারিখ। আফগানিস্তানে ঘন ঘন বিদেশী আক্রমণ এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কেউ তাদের নথিপত্র সাথে নিয়ে চলাফেরা করতে পারতো না। ন্যাটো এবং আমেরিকার কর্তৃপক্ষ ২০০১ সালের পর যখন আফগানিদের জন্ম তারিখে জানতে চাইতো ওদের অধিকাংশ লোকে উত্তর দিত ১ জানুয়ারি। কেননা এই তারিখটা মনে রাখা খুব সহজ। এই অবস্থায় সেই দেশের জনপ্রিয় জন্ম তারিখ হয়ে যায় ১ লা জানুয়ারি। এই বিষয়ে দি ওয়াশিংটন পোষ্ট একটি রিপোর্ট করেছিল যার শিরোনাম হল ‘In Afganistan, Jan 1 is everyone’s birhtday’ ।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত অন্যান্য দেশ, যেমন ভিয়েতনাম সোমালিয়া সুদান ইত্যাদি দেশেও অনেকে ১ লা জানুয়ারিকে জন্ম তারিখ হিসেবে বেছে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশকারী অধিকাংশের জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি। আফ্রিকান কিছু দেশে একটি প্রচলিত কথা শোনা যায়। কথাটি হল, ‘আমি বাজি ধরতে পারি যে তোমার জন্মদিন ১ জানুয়ারি’ তখন বেশিরভাগ লোক উত্তর দেয় ‘ তুমি ঠিকই বলেছ’। নেপালেও এই দিনটিতে অনেকের জন্ম তারিখ হিসাবে নিবন্ধন করা আছে। অনুন্নত অনেক দেশের এতিমদের জন্ম তারিখ নিবন্ধেও ১লা জানুয়ারি প্রচুর ব্যবহৃত একটি দিন।
ইদানীং পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকার কানাডার মত রাষ্ট্র জন্ম তারিখের মাধ্যমে পরিচয় নির্ধারণের জন্য একাধিক ডাটাবেজ ব্যবহার করে থাকে। সেই অবস্থায় স্বামী স্ত্রী কিংবা পরিবারের অন্য কোন সদস্যদের জন্ম তারিখের মিল কিছু বাড়তি প্রশ্নের জন্ম দেয়। অনেকে সময় সারপ্রাইজ বার্থডে শুভেচ্ছা পায় তারা। বিদেশের অফিসগুলোতে অনেক সময় জন্মদিনে কেক কাটা একটি সোশ্যাল এক্টিভিটিজের মধ্যে পরে। যাদের প্রকৃত জন্মদিন ১লা জানুয়ারি না তাদেরকেও লম্বা বন্ধের আগে কিংবা পরে একটি কেক কাটতে হয়। যাইহোক, যাদের জন্ম ১ লা জানুয়ারি না অথচ লতিফ স্যারদের হাতে তাদের জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি হয়ে আছে সেই জন্ম তারিখটার পাশেই কিন্তু ওই সমস্ত মানুষগুলোর মৃত্যু তারিখ লেখা থাকবে। তার মানে মনের অজান্তেই আমাদের অনেকের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত লতিফ স্যারেরা উপস্থিত থাকবেন। সাধু সাধু!!
সমস্ত বিশ্বে যাদের জন্ম ১লা জানুয়ারি, তাদের সকলকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)