কবি অন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতি কার, আর তিনি যদি হোন হেলাল হাফিজ? ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবি তিনি। এক ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ দিয়েই তিনি ‘অমরত্ব’ পেয়ে গেছেন কবিতার সাম্রাজ্যে। কথা হলো অমরত্ব পেলেইতো চলে না। কবিওতো মানুষ। ষড় রিপু সমৃদ্ধ মানুষ। তাহলে হেলাল হাফিজের মতো মানুষ, কবি এই শহরে টিকে থাকেন কী করে- যখন তিনি অনেক দিন ধরে কোনও চাকরি-বাকরি করেন না! সেসব না হয় রহস্যের আড়ালেই থাক। কথা হোক তার চোখের আলো নিয়ে।
একটু একটু করে তার দৃষ্টি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই শহরের গন্ধ তার নাকে এসে আছড়ে পড়বে অথচ শহরটাকে দেখতে পারবেন না, এটা কী করে হয়! মানুষ এসে দাঁড়াবে তার সামনে, বসবে মুখোমুখি অথচ হেলাল হাফিজ তাকে দেখবেন না, এটা মেনে নেয়া যায়?
হেলাল হাফিজের একটা কবিতা আছে- ‘ভালোবেসেই নাম দিয়েছি তনা/মন না দিলেও ছোবল দিও/ তুলে বিষের ফনা’।
‘তনা’ যদি হোন নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন, তাহলে তার একটি ফেসবুক পোস্টে জানা গেলো হেলাল হাফিজের চোখ থেকে ক্রমশ আলো ক্ষয়ে যাওয়ার কথা।
‘আমার বোন আজ কবি হেলাল হাফিজের সঙ্গে দেখা করেছে। ইনবক্সে দু’জনের কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। জানিনা আজ কত বছর পর হেলাল হাফিজকে দেখলাম। সম্ভবত তিরিশ বছর। খুব খারাপ একটা খবর দিলো বোন, হেলাল হাফিজের একটি চোখ নাকি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে, ও চোখে নাকি তিনি একেবারেই এখন দেখতে পান না। ছানি কাটাতে গিয়েই নাকি ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আরেকটা চোখের জ্যোতিও নাকি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
তাহলে কি তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন!একসময় হেলাল হাফিজের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল খুব। আমার নির্ভেজাল শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। খুব স্নেহ করতেন। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। ময়মনসিংহ থেকে আমি ঢাকায় বেড়াতে এলে প্রায়ই প্রেসক্লাবে ডাকতেন, দুপুরে খাওয়াতেন, গল্প করতেন। উজাড় করে দিতেন, শুধু দিতেনই। কিছু নিতেন না। এত নির্লোভ আর নিঃস্বার্থ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি জীবনে।’
নাসরিন আরও অনেকখানি লিখেছেন হেলাল হাফিজকে নিয়ে। শেষবাক্যে বলেছেন, ‘এত আলোকিত মানুষের চোখে এত অন্ধকার মানায় না।’
হেলাল হাফিজ এই শহরে, যন্ত্রণার শহরে এক সন্তমানুষ। সাধুকবি। ‘লোভ’ আর ‘খুন’র শহরে তিনি এখনো লোভহীন মানুষ-একা। এখনো তার কাছে শেষকথা জানতে চাইলে উজ্জ্বল হেসে বলেন, ‘প্রেম প্রেম এবং প্রেম’।
যাপিত জীবনে বেশিরভাগ মানুষ টাকা জমায়। যৌবনেই তিনি কবিতায় মানুষ জমানোর পণ করেছিলেন। যে মানুষটা সুখ-স্মৃতি নয়, মনে রাখতে চান নান্দনিক বেদনা তার; চোখ নষ্ট হয়ে যাবে অবহেলায়, চোখের দ্যুতি নিভে যাবে অযত্নে, তা কি হতে পারে? তাহলে উপায়-বুদ্ধি?
আছে, নিশ্চয়ই আছে। এই শহরে এখনো অনেক অনেক ‘প্রাণ’ আছে যারা হেলাল হাফিজের সৌন্দর্যটা জানে। জানে বাঁধনটুকু। এখন কেবল একটু উদ্যোগ প্রয়োজন। হেলাল হাফিজতো এমন মানুষ নন যে কারো কাছে কিছু চাইবেন। তিনিতো কেবল দিতে এসেছেন। ১৯৬৯-এ দিয়েছেন নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়। বাংলাদেশের তরুণরা সেই আলোতে এখনো তেজিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। সঙ্গে প্রেমতো আছেই। প্রেমের বার্তাবাহক হেলাল হাফিজ। তার চোখের আলো নিভে গেলে অনেকদিনের জন্য এ শহর অন্ধ হয়ে যাবে, কবিতা প্রেম খোঁজে পাবে না, আমি বলে দিচ্ছি, এ কেবল কথার কথা না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)