বাংলা কথা সাহিত্যের ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন কিংবদন্তিতূল্য। মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ বেদনার কাব্যগুলো তার লেখনীতেই পেয়েছে সার্থক রূপ। আর তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের ‘গল্পের জাদুকর’। সাবলীল ভাষায় সরস ভঙ্গিতে তার গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা মোহিত করেছিল সবাইকে । তার সেই গল্পের ফাঁদে বাঙালি পাঠকদের বুঁদ হতে হয়েছিল তাই।
তবে কেবল সাহিত্য বা চলচ্চিত্রেই নয় হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির ভুবন আরো বিশাল ও ব্যাপক। নাটক, চলচ্চিত্রেও সমান দাপটে কাজ করেছেন। এমনকি রঙতুলি নিয়ে খেলার অভ্যেসও ছিল তার। বিশেষ করে জীবনের শেষদিনগুলোতে এসে হাসপাতালে বসে ছবি আঁকাটা হয়ে গিয়েছিল নেশার মতো। ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ তখন। আর হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুর কাঠপেন্সিলে এঁকে যাচ্ছেন এসব চিত্রকর্ম।
হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবির বিশাল একটা জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি। প্রকৃতি ও জীবনকে তিনি খুব একটা বেশি আলাদা করে দেখেননি। জীবন সেখানে ভেসে চলেছে অথৈ সমুদ্রে। অথবা দু’পাশে আদিগন্ত গাছের সারি। মাঝখানে বয়ে গেছে শান্ত এক নদী। ছবির স্বচ্ছ সাদা জলে সে বৃক্ষরাজির ছায়া। তবে জলরঙে আঁকা গাছগুলোর পাতা অতো সবুজ নয়। যেন দুপুরের তপ্ত রোদে জ্বলছে। হয়তো এটাই তার গল্পের ময়ূরাক্ষী নদী।
জীবনের মধ্য দুপুরে মানুষের কোন ছায়া থাকে না। হুমায়ূনের আঁকা ছবিতেও এসেছে সে মধ্যাহ্নের গল্প। নিপাট ঝকঝকে দুপুরে দাড়িয়ে আছে একলা মানুষ আর বৃক্ষ। পাশে মেঘের মতো সাদা প্রকৃতি।
আবার লাল শাড়ি পড়ে বালিকা গেছে বনে। দীঘল কালো চুল তাহার, কৃষ্ণচূড়ার সাথে মিলে যায় বালিকার শাড়ির রঙ। বালিকাই কি কৃষ্ণচুড়া হয়ে ফুটেছে সবুজ বনানীতে? তবু বালিকার মাঝে আমরা তাড়া দেখতে পাই। ফেরার এক তাড়া।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতো ছবির মানুষগুলোও অদ্ভুত ও নিঃসঙ্গ। ছবিগুলোতে মানুষের পাশাপাশি মানুষকে দাড় করাননি কখনো। মানুষের সাথে প্রকৃতির সাক্ষাৎ ঘটিয়েছেন সচেতনভাবেই।
চারদিকে তখন শরতের সাদা মেঘের ভেলা । সেখানে একলা একা দাড়িয়ে এক কিশোরী মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার আপন ছায়া।
ঘন মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। পাল ছাড়া এক ছোট্ট নৌকা , কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে সেই নৌকা। ২০১২ সালের দিকে নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালের জানালার পাশে বসেই হয়ত লেখক, চিত্রশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ একলাই নৌকার তরী বেয়ে গেছেন তার রঙ তুলিতে। ছবিতে অদ্ভুত এক বিষন্নতা জেঁকে বসেছে যেন চারদিকে।
উপন্যাসে মতো তার ছবির নামগুলোও বেশ চমৎকার। এই যেমন পুরোনো সেই দিনের কথা, মেঘের খেলা দেখে কতো খেলা পড়ে মনে, তৃষ্ণা, ফাগুনের নবীন আনন্দে ক্লান্ত দুপুর, সুন্দরবন, কার ছায়া গো জলে?, ফেরা, বন মর্মর, যাত্রা, ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে, বৃক্ষের তন্দ্রা, মেঘবালিকা, কৃষ্ণচূড়ার কান্না দিনের শেষে, স্বপ্ন, আমেরিকায় বসন্ত, বনবালা, মধ্যাহ্ন এবং পুষ্পকথা।
হুমায়ূন আহমেদের আঁকাআকি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে দেশের বরেণ্য কার্টুনিষ্ট ,উন্মাদ সম্পাদক সেই সাথে হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবীব চ্যানেল আইকে বলেন, ‘লেখক হিসেবে তিনি বেশ ভালোই আঁকতেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে বেশ চিন্তার বিষয় জড়িয়ে ছিল তা তিনি ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছোটবেলা থেকেই হুমায়ূন আহমেদের ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল বলেও জানান তিনি।
তিনি তার মৃত্যুর আগে সব ভাই বোনদের একটি করে করে ছবি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন’। তার চিত্রকর্ম নিয়ে কোন প্রদর্শনী হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, জাতীয় জাদুঘর শাহবাগে ২০১৪ সালে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল পরে হবে কিনা জানা নেই।
গল্পের মতোন হুমায়ূনের ছবির চরিত্রগুলোও অতি সাধারণ মানুষ। তার ছবির ভাষাও সহজে পাঠযোগ্য। খুব বেশি দূর্বোধ্যতা সেখানে নেই। তার তুলি তাই সরল এক জীবনের কথাই বলে। তবু নিমগ্ন পাঠক চাইলেই খুঁজে নিতে পারেন গভীর এক বোধ।