বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা এবং সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা লাইনে লাইনে ফুটে উঠেছে হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে।
অনেক আগে থেকে এ ব্যর্থতার শুরু এবং এর শেষ কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর খুনিদের বিদেশে পাড়ি জমানোর মধ্য দিয়ে।
গোয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে নাইট প্যারেড। সেখানে নৈশ মহড়ার নামে কয়েকশ সেনাকে এক করে রাষ্ট্রপতিকে হত্যার উদ্দেশে ট্যাংকবহরসহ রওনা হওয়ার পরও সর্বোচ্চ পর্যায়ের কেউ সেটা জানতে পারেন নি, অথবা জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেন নি।
বড় এ ব্যর্থতার বিস্তারিত পরের পর্বগুলোতে থাকবে। এ পর্বে প্রথমে ১৪ আগস্ট বিকেলের ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ভবন কোনো প্রাসাদ বা দূর্গ না হলেও, একাধিক খুনি ঐতিহাসিক ছোট ওই বাড়িটিতে আগে একাধিকবার গিয়ে থাকলেও; নিরাপত্তা ব্যবস্থার সর্বশেষ অবস্থা দেখতে ১৪ আগস্ট বিকেলে কমপক্ষে দু’ খুনি বাড়িটি ‘রেকি’ করে এসেছিলো।
তাদের একজন আগেই পদচ্যূত সেনা কর্মকর্তা মেজর শরফুল হক ডালিম এবং আরেকজন সেসময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইউনিটের একজন সাবেক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। সেখানে তাদের উপস্থিতি এবং মোটর বাইকে একাধিকবার চক্কর দেওয়াটা অস্বাভাবিক হলেও কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করেন নি, কোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনে নি।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের একজন গার্ড কমান্ডার হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পাঁচ নম্বর সাক্ষী সুবেদার গণি জানিয়েছেন, কুমিল্লা ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারিতে মেজর ডালিম ও ক্যাপ্টেন হুদা তাদের অফিসার ছিলন। কিছুদিন পর মেজর ডালিমের চাকরি চলে যায়, ক্যাপ্টেন হুদা ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন।
গণি বলেছেন, ১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ডিউটিতে ছিলেন তিনি। আনুমানিক বিকেল ৪টার দিকে তিনি তাদের আগের কমান্ডিং অফিসার ডালিমকে মোটর সাইকেলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখেন।
পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাদের সাবেক অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন হুদাকেও মোটর বাইকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন তিনি।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ততোক্ষণে চূড়ান্ত হয়ে গেছে পরদিন ১৫ আগস্টই ঘটতে যাচ্ছে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সেটা প্রতিহত করার জন্য কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিলো না। এমনকি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও সক্রিয় ছিলো না। থাকলে হুদা-ডালিম সেখানেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তো। তার চেয়েও বড় বিষয় আইন প্রয়োগে কঠোরতা থাকলে মেজর ডালিমের তখন বাইরে থাকার কথা না, ততোদিনে তার ঠিকানা হওয়া উচিত ছিলো কারাগার।
তারা বলেন, মেজর ডালিম যে অপরাধ করেছিলো তাতে শুধু পদচ্যুতিই যথেষ্ট ছিলো না। একই কথা প্রযোজ্য আরেক খুনি মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। অপরাধের মাত্রা হিসেবে ওই দু’জনসহ আরো কয়েকজনের চাকুরিচ্যুতির পাশাপাশি কারাগারেই থাকার কথা ছিলো। কিন্তু সেটা হয় নি। আর সে কারণেই তারা ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পেরেছিলো।
তাদের অপরাধের বিষয়টা মেজর সৈয়দ ফারুক রহমানের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ১৬৪ ধারায় ফারুকের জবানবন্দিটা এরকম: ওইসময় লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু অফিসার ও জওয়ান গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি তছনছ করে। তাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে মেজর ডালিম, মেজর নূর ও আরো কয়েকজনের চাকরি চলে যায়।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন: এটা বিস্ময়কর যে কিছু সেনা অফিসার একজন মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পর তাদের শাস্তি হয়েছে শুধু চাকুরিচ্যুতি! কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবজাত ভালোবাসার কারণে তাদের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। এ কারণে মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পরও ডালিম এবং নূরের কারাদণ্ডের মতো শাস্তি হয় নি। এর প্রতিদান তারা দিয়েছে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে।
খুনিদের কেউ কেউ আবার বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের পূর্বপরিচিত ছিলো। হুদা-ডালিম-নূরসহ খুনিদের অনেকেরই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাতায়াত ছিলো নিয়মিত অথবা সময় সময়।
তাদের মধ্যে শেখ কামালকে ব্রাশফায়ার করা এবং পরে ৩২ নম্বরের সামনে মেজর ফারুককে ‘অল আর ফিনিশড’ বলে রিপোর্ট করা ক্যাপ্টেন হুদা মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তার ডিউটি ফোর্সকে দেখাশোনার জন্য আসতো বলে জানিয়েছেন মামলার এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম।
প্রসিকিউশনের চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুদ্দুসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন হুদা শুধু শেখ কামালকেই হত্যা করেনি, মেজর নূরসহ স্টেনগানের গুলিতে বঙ্গবন্ধুকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো হুদা।
হুদার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি গুলি করা মেজর নূর শেখ কামালের বন্ধু ছিলো বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী এবং বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ মুহিতুল ইসলাম। নূর জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ১২ নম্বর থিয়েটার রোডে ওসমানীর অফিসে নূরের সঙ্গে তার পরিচয়।
‘শেখ কামালের বন্ধু হিসেবেও নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতো,’ বলে জানান মুহিতুল।
একইভাবে মেজর ডালিমও অনেকবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। বেতারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা ঘোষণা করে ৩২ নম্বরে উপস্থিত হয় মেজর ডালিম। সেসময় মেজর ফারুকও ট্যাংকে চড়ে সেখানে উপস্থিত হয়।
পঁচাত্তর সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর ইন-চার্জ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এই মেজর ফারুকেরও ছিলো নিয়মিত উপস্থিতি।
এটাকে অবশ্য তার দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক। আদালতে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে তার দাবি ছিলো, ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে তার নিজের নিরাপত্তাকর্মীরা হত্যা করেছে, চাইলে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর ইন-চার্জ হিসেবে তার পক্ষেও সেটা সম্ভব ছিলো।
একুশ বছর ধরে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসেবে দাবি করে আসলেও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর এভাবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া তার ভিডিও সাক্ষাতকারও অস্বীকার করেছিলো ফারুক।
মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং যুক্তিতে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছে, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার সময়ের চেয়ে ট্যাংক রেজিমেন্ট হিসেবে ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই ফারুক রাষ্ট্রপতিকে হত্যার সুযোগ নিয়েছে। সঙ্গে পেয়েছে তার ভায়রা ভাই টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার কর্নেল রশিদকে।
(আগামীকাল চতুর্থ কিস্তি: সবার শেষে হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে)