বাংলাদেশের সিনেমা হলে হিন্দি ছবি প্রদর্শনে উদ্বেগ যথার্থ বলে মনে করেন অপর্ণা সেন। তার মতে যৌথভাবে চলচ্চিত্র উন্নয়নে রাষ্ট্র পর্যায়ে কথা বলা জরুরী। রাজ্য এবং রাষ্ট্র আলোচনার ফলে বাঁধাটা দূর হচ্ছেনা বলেও অভিমত তার।
সাংবাদিকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথোপকথনে এমনটি জানিয়েছেন ‘চতুষ্কোণ’ অভিনেত্রী বা ’৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ নির্মাতা। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের আনুষ্ঠানিক কথোপকথনের দিনে যৌথভাবে চলচ্চিত্র আদানপ্রদান এবং নির্মাণ বিষয়ে কথাগুলো বলেন অভিনেত্রী, নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার এবং সাংবাদিক পরিচয়ের অদ্বিতীয় অপর্ণা সেন।
সত্যজিৎ রায় এর প্রেরণা এবং উৎসাহে নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল বলে সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানান অপর্ণা সেন। এ ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন অভিনয়ের বিরতিতে আমি কিছু লেখার চেষ্টা করছি। লেখা পড়ে মানিক কাকু বুকে জড়িয়ে বললেন, এটা বানিয়ে ফেল। তিনি বুদ্ধি দিলেন শশী কাপুরকে চিঠি লিখতে প্রযোজনার জন্য। সাড়াও দিয়েছিলেন তিনি। তারপরতো ইতিহাস।’ প্রাসঙ্গিক একটি তথ্য জানিয়ে অপর্ণা নিশ্চিত করেন, ছবিটিতে জেনিফারকে তিনি নিজে নিয়েছিলেন। শশী কাপুরের রিকমান্ড ছিলনা।
কষ্ট এবং আক্ষেপ মেশানো স্বরে তিনি শুরু করেন। বলেন, পরমা’ বা ‘পারমিতার একদিন’ নারীবাদী ছবি হিসেবে সবার কাছে পৌঁছায়নি। যে দুটো ছবির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন বা নিজের অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছি, সে দুটো ছবিই দর্শকের কাছে পৌঁছায়নি। দুটো ছবিই ইংরেজিতে নির্মিত। ইংরেজি ছবির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। আমরা প্রডিউসার পাই না। তারা হিন্দিতে ছবি করতে চান। সেখানে বাংলাদেশে সিনেমা হলে হিন্দি ছবির প্রদর্শনে তাদের উদ্বেগ ঠিক আছে। রাষ্ট্র এবং রাজ্যের বাধা কাটিয়ে বাংলা ছবি আদান প্রদানের পথ বের করলে সবচেয়ে ভালো হয় জানিয়ে অপর্ণা বলেন, আমি যতদূর জানি, দুই দেশের চলচ্চিত্র আদানপ্রদানের বাধার মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশের বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র নেওয়ার জায়গাটি। দেখি এ জায়গাটায় আমি ব্যক্তিগত ভাবে কী করতে পারি?
বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ ব্যবহৃত ভাষা বাংলার বিশ্বজুড়ে থাকা বাঙ্গালিদের কাছে সহজে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।
তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করে আরো বলেন, রাষ্ট্র এবং রাজ্য বলেই হয়ত যৌথভাবে কাজ করার বাধাটা থেকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র আর আমরা পশ্চিমবঙ্গ একটি রাষ্ট্রের রাজ্য- এ ব্যবধান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। দুই রাষ্ট্র পর্যায়ের আলোচনায় সমাধান হতে পারে সমস্যার।’
‘ইতি মৃণালিনী’ অপর্ণা মন খুলে কথা বলেছেন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে। তার সর্বশেষ নির্মিত চলচ্চিত্র ছিল ‘সোনাটা’। তার প্রদর্শনী ছিল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে। তিনি বলেন তার শেষ দুটি চলচ্চিত্র সারি রাত’ এবং ‘সোনাটা’ নাটক থেকে নিয়েছেন তিনি।
একটি প্রশ্ন ছিল অপর্ণার কাছে, ‘ইতি মৃণালিনী’ কি আপনি? আপনার ব্যক্তি চিন্তা এবং জীবন এতে চিত্রিত হয়েছে?’ কিছুটা বিরক্ত স্বরে বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন সৌরভ বলেন, ‘এ ধরণের প্রশ্ন খুব একটা পছন্দ নয় আমার। তারপরও বলছি, আমার প্রতিটি চলচ্চিত্রই আমি। ব্যক্তিগত উপলব্ধি না হলে সত্যবর্তী হওয়া যায়না। শুধু এটুকু বলব, হ্যা আমি মৃণালিণী। আবার আমি মৃণালিনী নই। আমার চিন্তার চিত্রায়ন চলচ্চিত্রটি সে ক্ষেত্রে আমি মৃণালিনী। প্রতিটি নির্দেশকের নিজের ভাবনাই চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়। না হলে সেটা তার ব্যর্থতা। অন্যদিকে এ ছবির সঙ্গে আমার জীবনের মিল নেই। হ্যা এ চরিত্র প্রেসিডেন্সিতে পড়ে। আমিও পড়েছি। এটুকু ছাড়া আর কোন মিল নেই। চলচ্চিত্রের চরিত্র আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। আমি কখনও আত্মহত্যার চেষ্টা করিনি। আমার কোন নক্সালাইট প্রেমিক ছিলনা। বরং আমি হয়ত কিছুটা নক্সালাইট ছিলাম।
ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে তুলে ধরার এধরণের প্রয়াস প্রসঙ্গে ওঠা প্রশ্নে সতর্কতার সঙ্গে অপর্ণা বলেন, যে ছবিগুলোর কথা বললেন তা আমার দেখা হয়নি। তাই মন্তব্য করা বোকামী। তবে আমার চলচ্চিত্রে কখনও এরকম হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যে সম্পর্ক তা যেমন ভাষার মিল তেমনি হৃদয়ের টানও ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের যে ধারণা তা ভারতের সমস্ত পর্যায়ে একরকম না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
অনেক নির্মাতা নিজে ক্যামেরা চালাতে পছন্দ করেন বা টেক নিতে পছন্দ করেন। আপনার বেলায় কী ঘটে?’ এমন প্রশ্নে কিছুটা ভেবে অপর্ণা বলেন, আমি টেক করিনা। আমি চিত্রকল্প দেখতে পাই। আমি যা চাই তা ডিটেল আলোচনা করি। চলচ্চিত্র একটি মিলিত মাধ্যম। প্রত্যেকের এখানে ইনপুট দেওয়ার সুযোগ থাকে। কারো ভালো কিছু যদি নেওয়ার সুযোগ থাকে তবে আমি কেন নেবনা? না নেওয়াটা আমার কাছে বোকামী। কেউ হয়ত এ বোকামী পছন্দ করেন। আমি পারিনা।’
কথোপকথনে উঠে আসে তার মামা কবি জীবনানন্দ দাশের প্রসঙ্গ। স্মৃতি হাতড়ে অপর্ণা বলেন, তাকে মিলু মামা বলে ডাকতাম। তবে সেই ছোটটি থেকে আত্মীয় হিসেবে না ভেবে কবি হিসেবেই ভেবেছি। আজও তাই। বাংলা কবিতার কি যে বাকবদল তিনি করেছিলেন তা ভাবলেই অবাক হই।’ ‘বেঁচে থাকতে তার খ্যাতি না পাওয়ার প্রসঙ্গে অপর্ণা সহজ কণ্ঠে বলেন, ‘এরকম অনেক ঘটনা আছে। এটি অস্বাভাবিক নয়।’
২০০০ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম এসেছিলেন জানান অপর্ণা সেন এর সঙ্গে মিট দ্য প্রেস এ থাকা উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতাবা কামাল। আবার আসলেন ১৮ বছর পর।’ তথ্যের সূত্র ধরে অপর্ণা সেন বলেন, ‘মাঝে কয়েকবার আসতে চেয়েছি। নানা জটিলতায় হয়ে ওঠেনি। তারপর আক্ষেপ মাখা স্বরে বলেন, আমার গয়নার বাক্স চলচ্চিত্রের বড় অংশ বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল। হয়নি ফলে নদীর ধারে জমিদার বাড়ির অংশের শুটিং আমাকে ভিএফএক্স এ করতে হয়েছে। পড়ে শুনেছি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ছিল। এই আক্ষেপ আমার চিরকালের জন্য রয়ে গেল।’
এ উৎসব নম্বর বিবেচনায় বিশ্বের অনেক উৎসবে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতায় কত পাবে প্রশ্নে আন্তরিক স্বরে অপর্ণা বলেন, ‘একটি উৎসব আয়োজন যে কত ঝক্কি তা আমি জানি। আমার বাবা মানিক কাকুরা চলচ্চিত্র আন্দোলন করেছেন উৎসব করেছেন। অনেক আসরে গিয়েছি তবে বেশির ভাগ জায়গায় জমকের যত গর্জন থাকে ততটা উষ্ণতা থাকেনা। যেটা এখানে মেলে।’