চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

হিংসায় মানুষ মরছে

হিংসার ব্যাপ্তিতে লঙ্ঘিত মানবতা। হিংসার কাছে তুচ্ছ মানবতা, হিংসার কাছে পরাজিত মনুষ্যত্ব। হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার ধর্ম-বর্ণ-জাতি। পৃথিবীর সব দেশের ভাষার বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা, মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু বাস্তবতা আজ অন্য রকম। বাস্তবতা হল তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মানুষ নির্বিবাদে মানুষকে খুন করছে। পাখির মত গুলি করে মারছে। 

‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’ – জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এ কথাটিকেই আপ্রাণ বিশ্বাস করেছি, ভেবেছি, ভালোবেসেছি মানবজাতকে৷ আজ কারণে-অকারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। দেশে বিদেশে সবখানে আমরা মানুষ মারছি, কাউকে আমরা মারছি, কেউ আমাদের মারছি। জাতে, বর্ণের, ধর্মের দোহায় দিয়ে মানুষ হত্যা করছে মানুষকে। কিছু মানুষের কাছে পশুপাখির তুলনায় মানুষের মূল্যহীন। মানুষের উপর প্রতিদিন মানুষের উপর চলছে সহিংসতা। আর এই সহিংসতার সীমানা নাই, কাল নাই, জাত নাই৷ আছে শুধু হিংসা আর অর্থের প্রবল ক্ষুধা৷ বাংলাদেশ, মিয়ানমার,সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, আমেরিকা, ভারত পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া,ফিলিস্তিন, সৌদি আরবসহ পৃথিবীর সব দেশে দেশে চলছে এই সহিংসতার, হত্যার হামলার৷ এই বর্বরতার শেষ নাই, সীমা নাই!

এই সহিংসতায় মানুষ দেখে, রোহিঙ্গা মুসলিম মরছে, খ্রিস্টান মরছে, হিন্দু  মরছে, মুসলিম মরছে, ইহুদী মরছে, বৌদ্ধ মরছে, মারমা, মরছে, সাঁওতাল মরছে, শিখ মরছে সুন্নি মরছে,শিয়া মরছে আহম্মদী মরছে। সাদা মরছে, কালো মরছে, গরীব মরছে, ধনী মরছে, আমি দেখি মানুষ মরছে। রোজ মানুষ মরছে। সকালে, রাতে দুপুরে মানুষ মরছে। কারণে অকারণে মানুষ মরছে। রাজনীতির চালে মানুষ মরছে, ক্ষমতার চালে মানুষ মরছে। যেভাবেই হোক মানুষে মানুষে বিভাজন করো, মানুষকে ঐক্য ভ্রষ্ট করো –এই চলছে দুনিয়া জুড়ে৷ যে ভূখণ্ডে যে জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কম বা ক্ষমতাহীন, সেই দুর্বলদের ওপর সবলকে লেলিয়ে দিয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘুমপাড়ানি গান দিয়ে মানুষকে শাসন-শোষণের এই হিসাবে মানুষ মারছে পৃথিবীর ফ্যাসিস্ট শাসকেরা।

পৃথিবীর সকল ধর্মই বলে শান্তির কথা, বলে মানবতার কথা। কিন্তু এই ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ব্যবসা, এই ধর্মের নামেই হত্যা করা হচ্ছে হাজারো মানুষ। জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার নিচে সারাবিশ্বের মানুষ। হোক পশ্চিমা দেশ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, কোনো দেশই আজ ঝুঁকি মুক্ত নয়। কিন্তু কেন এই অবস্থায় আমরা আজ এসে উপনীত হলাম? এর জন্য কে দায়ী? আজ সারা বিশ্বেই ধর্মকে অনেকেই দায়ী করে থাকেন কিন্তু তারা ধর্মের শিক্ষা সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না বলেই এ অবস্থা।

আর এই অবস্থার কারণেই কাল নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের দুইটি মসজিদে হামলায় ৪৯টা তরতাজা প্রাণ নিভে গেল প্রার্থনার সময়! কেউ হারালো মা, কেউ বাবা হারালো, কেউ ভাই, কেউ হারালো বোন, কেউ বা সন্তান। সান্ত্বনার ভাষা নেই। আমার ঘৃণা সন্ত্রাসীদের প্রতি।

হিন্দু, না, মুসলমান না, খ্রিস্টান না, সন্ত্রাস করে সন্ত্রাসবাদীরা। জঙ্গিরা কোন ধর্মের না তারা, জঙ্গিবাদী জঙ্গিধর্ম তাদের ধর্ম। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কোনো ধর্ম হতে পারে না। তাদের একটাই ধর্ম পরিচয়- সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে শুক্রবারের হামলার ঘটনা অনলাইনে সরাসরি দেখিয়েছে হামলাকারী নিজেই। একইসঙ্গে অনলাইনে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রে এই হত্যাকাণ্ডের কারণও বর্ণনা করেছে সে।

এখন পর্যন্ত ওই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৯জন মানুষ। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ।

অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক গণমাধ্যম নিউজডটএইউ জানিয়েছে, ক্রাইস্টচার্চের ডিনস এভিনিউয়ের আল নুর মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৪০মিনিটের দিকে সেখানে হামলার সূত্রপাত হয়। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই শহরের লিনউড এভিনিউয়ের আরেকটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, সশস্ত্র হামলায় ডিনস এভিনিউয়ের আল নুর মসজিদে ৪১জন ও লিনউড এভিনিউয়ে ৭জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান লিনউডে আহতদের আরেকজন।

হামলাকারী টুইটারে নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক এবং ‘ব্রেন্টন টারান্ট’ নামে পরিচয় দিয়েছে। হামলার সময় সে ক্যামেরা চালু করে পুরো ঘটনাটি অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করে।

নিউজিল্যান্ড-মসজিদে হামলা-ট্যারান্টঅনলাইনে প্রকাশিত ৭৩ পৃষ্ঠার এক বিশদ ঘোষণাপত্রে নিজেকে ‘শুধুই একজন সাদা চামড়ার সাধারণ মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছে সে।

২৮ বছর বয়সী ওই হামলাকারীর বর্ণনানুযায়ী, ‘স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম তার। নিজের দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তার মতে, ‘আমাদের দেশ কখনোই তাদের হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন শ্বেতাঙ্গও জীবিত থাকবেন ততক্ষণ আমাদের দেশ আমাদেরই। তারা কখনোই আমাদের ভূমি দখল করতে পারবে না।’

দু’বছর ধরেই এমন হামলার পরিকল্পনা করে আসছিল বলে জানিয়েছে ব্রেনটন। তিনমাস আগেই ক্রাইস্টচার্চে হামলার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

তবে নিউজিল্যান্ডই তার হামলার মূল লক্ষ্য ছিল না বলেও উল্লেখ করে সে। বক্তব্যে ইসলামপন্থি জঙ্গি ও অভিবাসীদের ‘হামলাকারী’ আখ্যা দিয়ে নিউজিল্যান্ডে হামলার মাধ্যমে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বলে জানিয়েছে।

ব্রেন্টনের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই ‘হামলাকারীরা’ তাদের দেশে (অস্ট্রেলিয়া) থাকবে পৃথিবীর কোথাও অস্ট্রেলীয়রা নিরাপদ নন। এমনকি বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলও না। শ্বেতাঙ্গদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শ্বেতাঙ্গ শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা উচিত বলেও উল্লেখ করে সে।

উল্লেখ্য, ইউরোপ জুড়ে বিদেশি ‘হামলাকারী’দের হাতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি ব্রেন্টনের। ২০১৭ সালের সুইডেনের স্টকহোমে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১১ বছর বয়সী শিশু এব্বা একেরলান্ডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেও এই হামলা চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। উজবেকিস্তানের এক অভিবাসী ওই হামলা চালিয়েছিল।

কিছু ধার্মিক নামের মানুষ স্বর্গ লাভের আশায় প্রতিদিন মানুষ মারতে পেটে বোমা বেঁধে মসজিদে ঢুকে যায়, অস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় প্রার্থনারত মানুষের উপর। এদের কাছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, গুরুদুয়ারা বলে কিছু নেই। আবার কিছু মানুষ নিজেদের সম্পদ সর্বশক্তি ব্যয় করে মানবতাকে বাচায়, মানুষের জীবন বাঁচায়।

ক্রিস এবং রেগিনা ক্যাট্রামবোন যুগল। তারা একটি বড় জাহাজ কিনেছেন। কিন্তু তা ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়। বরং সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের উদ্ধারের জন্য। হ্যাঁ, একটু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, সাগরে ভাসমান হাজারো অভিবাসীদের জন্য নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ক্রিস। তার স্ত্রীকে নিয়ে কিনেছেন ১৩০ ফুটের একটি উদ্ধারকারী জাহাজ।

গত গ্রীষ্মে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর সময় হাজার হাজার মানুষ জাহাজ ডুবি বা সাগরে না খেয়ে সাগরে মারা যায়। এমন মানবিক ঘটনা নাড়া দিয়ে যায় ক্রিসকে। সেসময়ই সিদ্ধান্ত নেন উদ্ধারকারী জাহাজ কেনার। যুক্তরাষ্ট্রের এ নাগরিক তার ইতালিয়ান স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মাইগ্র্যান্ট অফশোর এইড স্টেশন (Migrant Offshore Aid Station (MOAS) । তাদের জাহাজের নাম দেন ফিনিক্স। ২০ জন জাহাজ কর্মী এবং তাদের কন্যা মারিয়া লুসিয়াকে নিয়ে নেমে যান সাগরে, মানবতার সেবায়। উদ্ধার করতে থাকেন অসহায় মানুষদের।

মানুষ ও মানবতার জয় একদিন হবেই। লিঙ্গ, ধর্ম, দেশ, গোত্র, জন্ম পরিচয়ের মত বিষয়গুলো নিক্ষিপ্ত হবে আবর্জনার  আস্তাকুঁড়ে। কালের বিবর্তনে এটাই চির সত্য। কারণ সত্যের কোনো চিরস্থায়ী রূপ নেই। তা চিরকালেই গতিশীল, জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবতার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)