দেশ ও রাজনীতি আপাতত সংলাপ-জ্বরে আক্রান্ত। ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে অপরাপর রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে চলমান সংলাপ নিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষ পুরোপুরি মগ্ন। সংলাপে কে যোগ দিলেন, কে দিলেন না, কে কী বললেন, কে কতটুকু কী খেলেন- এসব নিয়ে চলছে আলোচনা। সংলাপ থেকে কী মিলল, আদৌ কোনো লাভ হলো কি না-এসব নিয়েও চায়ের কাপে ঝড় বইছে। সংলাপ করে কিছুই হবে না, সংলাপ হচ্ছে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার সরকারি কৌশল-এমন কথাও অনেকে বলাবলি করছেন।
অবশ্য রাজনৈতিক সংলাপকে ঘিরে এমন মত-মন্তব্য নতুন নয়। এর আগেও যতবার জাতীয় নির্বাচন এসেছে ততবারই কোনো না কোনো পক্ষ থেকে সংলাপ অনুষ্ঠানের জোর দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো সময় সংলাপের আয়োজন হয়েছে। সেসব সংলাপে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেছে। নানা দাবি-দাওয়া সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষ কি দাবি তোলার ক্ষেত্রে, কি দাবি মানার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দেয়নি। ফলে সংলাপ কেবলই হতাশা আর ক্ষোভের স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। তারপরও সংলাপ হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে!
আমাদের দেশের নাগরিকদের এ এক আশ্চর্য বাতিক। কিছুদিন পর পরই ‘সংলাপ’-‘সংলাপ’ বলে মিডিয়া মাতিয়ে তোলেন। অথচ সংলাপ মানে হচ্ছে বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা, কথা চালাচালি।
সংলাপের মধ্য দিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান মিলেছে, সমস্যা সমাধানের কারণ উদ্ঘাটন করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে—এমন দৃষ্টান্ত আদৌ নেই।
কোনো কালেই কোনো পক্ষ কখনই কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করে না। প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপায়, আর নিজেদের পক্ষে সাফাই গায়। পক্ষান্তরে বিরোধী দল সরকারের কোনো কৃতিত্বকেই স্বীকার করতে চায় না। সরকারকে ব্যর্থ, অযোগ্য প্রমাণ করাই যেন তাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমাদের দেশের ট্রাডিশান হলো কোনো বিষয়ে একমত না হওয়া। একপক্ষ ডানে চললে আরেক পক্ষ চলে বায়ে। আর কেউ যদি ডানে চলার চিন্তা করে তাহলে অন্যজন বামে চলার ব্যাপারে গোঁ ধরে। তারপরও সংলাপ, সংলাপের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করাটা—অতি-আশাবাদ নয় কী?
যে পথের দিশা খুঁজে সবাই হয়রান; কোনদিকে গেলে মিলবে সে পথের সন্ধান? কোথায় সেই পথ? যে পথে গেলে মিলবে সম্প্রীতির রথ! এক সুরে গলা সাধা, রাগিণী—আলাপ হতে হবে, হতে হবে আলাপ-সংলাপ!
আমাদের দেশে সংলাপ যে রূপ লাভ করেছে, তাতে এর সন্ধি বিচ্ছেদ হচ্ছে: সঙ+আলাপ=সংলাপ; সমাস: সঙদের মাঝে যে আলাপ। এক নজরে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে সংলাপের ইতিহাস যদি দেখে নেওয়া যায় তাহলে আমরা দেখি: ১৯৭১-ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো সংলাপ, ফলাফল=মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৯৮৮-৯০- স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটদ্বয়ের বেশ কিছু সংলাপ, ফলাফল= আন্দোলনে এরশাদের পতন। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল এবং বিএনপি মহাসচিব মরহুম মান্নান ভুঁইয়ার সংলাপ, ফলাফল= সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত অসাংবিধানিক সরকার!
তারপরও আমরা সংলাপ চাই, সংলাপের দাবি তুলি, সংলাপে অংশগ্রহণ করি। এ বড় আশ্চর্য প্রবণতা। আমাদের রয়েছে কিছু আজব বৈশিষ্ট্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারি না। আমরা একসঙ্গে এক পথে চলতে পারি না। অন্যের মত মেনে নিতে পারি না। নিজের মতো চলব, নিজের কথা বলব—এই হলো আমাদের মোটো। তাতে যাকে যতটা খাটো করতে হয়, করব। যাকে ল্যাং মারতে হয়, মারব। নিজের জায়গা তো ছেড়ে দেই-ই না, পারলে যে পাশে আছে, তাকে গুঁতিয়ে যাব, যতোক্ষণ না সে জায়গা ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছে।
তো এই স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য নিয়েও আমরা সংলাপ-সংলাপ করে মাতোয়ারা হয়েছি। অনেক নাগরিকের মতে, সংলাপ না হলে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। বৈরিতা ঘুচবে না। অস্থিরতা দূর হবে না। চিন্তায় তারা ঘুমাতে পারছিলেন না। সংলাপের জন্য অনেকেই ব্যাকুল হয়ে উঠছিলেন।
কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? আদৌ কোনো গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তার এক নম্বর দাবিই হচ্ছে খালেদা জিয়ার মুক্তি। দশ বছরের মামলার লড়াইয়ে নিম্ন আদালত ও উচ্চআদালত দুই আদালত থেকেই যে খালেদা ১০ বছরের সাজা পেয়েছেন, তাকে মুক্তি দেয়ার দাবিকে সামনে আনা হচ্ছে কেন?
খালেদা জিয়ার মুক্তির সঙ্গে একটি ভালো নির্বাচনের সম্পর্ক কী? আর এই দাবি ক্ষমতাসীনরাই বা মানবে কেন? তাদের জন্য তো বরং এটা একটা সুযোগ!
নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যায়, সবাই যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, নির্বাচনের ফলাফল যেন সবাই মেনে নেয়, নির্বাচনে কালোটাকা, পেশি শক্তির ব্যবহার যেন কেউ না করে, ধর্মব্যবসায়ী, জঙ্গিবাদের সমর্থক নারী নির্যাতনকারীরা যেন মনোনয়ন না পায়, আগামী দিনে যেন সরকারি দল ও বিরোধী দল একে-অপরের সহযোগিতা নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারে তেমন কোনো দাবি বা আলোচনা দলগুলোর এজেন্ডায় আছে কি?
আমাদের দেশে প্রয়োজন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। একদলকে বিদায় দিয়ে আরেকদলকে ক্ষমতায় আনা, তারপর সেই দলের একনায়কত্ব মেনে নেয়া, প্রতিপক্ষের সর্বনাশ ঘটানো এই ধারার নির্বাচনের জন্য এত আলাপ-আলোচনা, জোট ইত্যাদির আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি?
সাধারণ মানুষের কি কল্যাণ হবে? বেকারত্ব কি কমবে? যুবরা কি কাজ পাবে? যন্ত্রপ্রযুক্তির বিকাশে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে? ঘুষ-দুর্নীতি কি বন্ধ হবে? লুটপাট-ধনী-গরিবের মধ্যে পার্থক্য ঘোচানোর জন্য কি করা হবে? আইনের শাসন কি প্রতিষ্ঠিত হবে? নারী নির্যাতন কমবে? বাল্যবিবাহ-যৌতুক প্রথা নিরোধ হবে? গরিবরা আরও সহজে কীভাবে চিকিৎসা পাবেন? এ ব্যাপারে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা কী?
দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা, এই জনগোষ্ঠীকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য প্রেরণ করার ব্যাপারে কী নীতি গ্রহণ করা হবে? যানজট নিরসনে কি করা হবে? ট্রেন ব্যবস্থা কতটুকু উন্নতি হবে? পানিপথের যোগাযোগ আরও বাড়ানোর জন্য কি করা হবে? শিক্ষার উন্নয়নের জন্যই বা কি করা হবে? সংখ্যালঘুরা যেন তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে, সে জন্য কী নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে?
সংলাপ হলে কী হবে? ক্ষমতাসীনরা বিরোধী পক্ষের সব দাবি মেনে নেবে? দুই পক্ষ সব বিবাদ কিছু মিটমাট করে নেবে? তারপরও বলা হচ্ছে, সংলাপের বিকল্প নেই।
আমরা অবশ্য বিকল্পের সন্ধান সব সময় করে আসছি। আজ যে কারণে সংলাপ চাই, কাল সেই একই কারণে যা বলব, সেটাকে কেউ প্রলাপ বললে আমাদের কী এসে-যায়। আবার হয়তো কিছুদিন পর এই সংলাপের জন্য বিলাপ করে বেড়াব। বলব পরিবেশ নষ্ট করেছে কেউ। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিতে আমাদের মতো ওস্তাদ আর কাউকে ‘কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ চলছে তাকে ‘রঙ-তামাশা’ বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। সংলাপের এমন পরিণতির কথা কি তিনি জানতেন না? আর সব কিছু জেনে শুনে তিনি সংলাপে অংশগ্রহণই বা করেছিলেন কেন? তা কি শুধু ‘শেয়ালের ঈমান’ পরীক্ষার আশায়?
পরিশেষে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, ‘আলাপ ও সংলাপের কথা আজ বাতাসে ভাসে/প্রলাপ ও বিলাপের দিনও সামনে বুঝি আসে!’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)