মাঝে মাঝে ধানমণ্ডির এক চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। তিনি বসেন প্রসিদ্ধ এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বেশ ঝকঝকে তকতকে সেই সেন্টার। দিনভর রোগীদের আসা যাওয়া। ব্যবসাও রমরমা। আমার রোগশোক যিনি দেখেন তিনি আদতেই ভদ্রলোক। গুছিয়ে কথা বলেন। খুবই সজ্জন প্রকৃতির মানুষ। চিকিৎসার পাশাপাশি কবিতাও লেখেন। মাকিদ হায়দারের মতো জনপ্রিয় কবিও ভদ্রলোকের গুণগ্রাহী। তো এই ভদ্রলোক অন্যান্য চিকিৎসকদের মতো কথা কম বলে মুখ নিচু করে প্রেসক্রিপশনে যত বেশি ওষুধপত্র আর টেস্টের ফর্দ লেখার চেয়ে তার কাছে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি প্রথম প্রথম যখন তার কাছে দেখাতে গিয়েছি তখন তার এ ব্যাপারটি আমাকে বেশ বিরক্ত করে তুলত। আমি তার এ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিলাম। এমনও হয়েছে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা তার জন্য বসে থাকতে হয়েছে।
আরে! রোগীর সঙ্গে এত কথা বলার কি আছে!
পরে তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তিনি রোগীদের সাথে যে গল্পগুজব করেন সেটাও তার চিকিৎসারই একটা অংশ। অবশ্য তিনি তার কথার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার কথা হলো, রোগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি তার রোগের পূর্বাপর অনেক তথ্য জেনে যাই যা একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার জন্য খুবই জরুরী। আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হলেও রোগীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে গিয়ে তিনি যে বিস্তর টাকাপয়সা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সে বিষয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। সেদিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে এই চিকিৎসক ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে একজন বোকা মানুষ।
সেদিনও গিয়েছিলাম তার কাছে।
বিশাল বিল্ডিংয়ের চার তলায় বসেন তিনি।
ঝিক ঝাক ডেকোরেশনে চেম্বারে অনেক পদের চিকিৎসকরা পসরা সাজিয়ে বসেন।
ভেতরে রোগী থাকায় রিসিপশনের সাজিয়ে রাখা চেয়ারে বসে দেয়ালে ঝোলানো টিভি স্ক্রিনে দেখছিলাম ন্যাশনাল জিওগ্রাফি।
টিভি স্ক্রিনের নিচে বিলিং কাউন্টার, সেখানে জনা তিনেক কর্মচারি মুখ হাসি হাসি করে বসে থাকেন। ডাক্তারদের রুম থেকে রোগী বেরিয়ে এলে উৎসুক হয়ে তাকান। ডাক্তার সাহেব কী কী টেস্ট করতে দিয়েছেন তা দেখেন। রোগীদের কাছ থেকে বিল রাখেন।
আমি আমার ডাক্তার সাহেবের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। আমার সামনে রিসিপশনের ডেস্ক। তার সামনে এক মানুষ সমান লম্বা বিলবোর্ড জাতীয় কিছু। আগের বার এটা চোখে পড়েনি। আজ দেখলাম। তাতে এক চিকিৎসকের ছবি। ভদ্রলোক মূলত চর্ম ও যৌন রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ।
হাতে সময় থাকায় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আমার মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। আমি চাল বাছার মতো করে খুব মনোযোগ দিয়ে সর্ব রোগের রোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসকের গুণপনা পড়তে থাকলাম।
একবার পড়লাম।
তারপর বেশ কয়েকবার।
অবাক কাণ্ড!
চিকিৎসক ভদ্রলোক যেসব রোগ বালাই দেখে রোগের চিকিৎসা দিতে পারেন সেসব রোগের ফিরিস্তি গুনলাম। গুণে গুণে ২৭টি রোগ (হাতের রেখা উঠে যাওয়া, নখের ডগায় সাদা ফুল ওঠা, হাত ঘেমে যাওয়া, তালু গরম হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘুম, ঘুম না হওয়া, স্বপ্ন ( স্বপ্নদোষ নয়) দেখা সহ অনেক অনেক রোগবালাই…) পড়ে আমার হাঁপিয়ে ওঠার অতিক্রম।
এর মধ্যে আমার ডাক পড়ল। আমি আমার চিকিৎসককে দেখিয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে বিলিং কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছু চাইছি কিনা জানার জন্য একজন দাঁড়ালেন। তার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। আমি তাকে সেই বিলবোর্ড আর বিলবোর্ডে লিখে রাখা রাজ্যের যতসব রোগের তালিকা দেখিয়ে দিয়ে বললাম,
নিচে যে একটু ফাঁকা জায়গা আছে সেখানে তো আপনারা আরেকটা রোগের নাম লিখে রাখতে পারেন।
আমার কথায় লোকটা বেশ আগ্রহ দেখিয়ে বলল,
কোন রোগ…?
এখানে হাত দেখা হয়…
কেন? কেন?
না, এই চিকিৎসক যেদিন কোনো রোগী না পাবেন সেদিন হাত দেখিয়ে দু’চার পয়সা কামাই রোজগার করতে পারবেন। কী খারাপ হয়!
বিলিং কাউন্টারের সেই লোকটা আমার কথা শুনে সম্ভবত খুব মজা পেলেন। ফিক করে হেসে ফেললেন।
মাঝে মাঝে কিছু কিছু হাসি মুখ দেখা পুণ্যের কাজ।