চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

হাসানুল হক ইনু ‘পরাগাছা’, খালেদা জিয়া ‘মহীরুহ’!

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর নাম উল্লেখ না করে তাকে ‘পরাগাছা’ হিসেবে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেছেন, এসব পরাগাছার জন্যে আওয়ামী লীগ শুকিয়ে যাচ্ছে! কত মানুষ যে এরা খুন করেছে! ‘রেগে গেলেনতো হেরে গেলেন’ বলে একটা কথা আছে বাংলা সাহিত্যে।

খালেদা জিয়া যে হাসানুল হক ইনুর ওপর ভীষণ রেগে আছেন সেটা তার বক্তব্যে স্পষ্ট। কারণ জনাব ইনু তাকে আগুন সন্ত্রাসের জঙ্গী নেত্রী নাম দিয়েছেন। কত সাহস তার! এখন এ লেখায় আমরা ‘পরাগাছা হাসানুল হক ইনু’ আর ‘মহীরুহ খালেদা জিয়া’র তুলনামূলক আলোচনা করবো।

‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা নিয়ে অনেক অপ্রিয় কথাবার্তা দুষ্টু লোকেরা নানান তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রায় ফাঁস করে দেয়! এই অনলাইন যুগের কারণে এসব আজকাল সবারই জানা। শুধু তার শিক্ষা জীবনের বিশেষ কিছু মার্কশিট না, পাসপোর্টসহ একাধিক জন্ম তারিখও ফাঁস করে দেয় এই দুষ্টু লোকের দল!

কিন্তু এই দুষ্টুরা যা বলতে পারে না বা বলা সম্ভব না তাহলো ‘খালেদা জিয়া সুন্দরী না’। সেজন্যে পড়াশুনা যাই থাক না কেন জিয়ার মতো একজন সেনা অফিসারের সঙ্গে বিয়েটা তার দর্শন যোগ্যতাতেই হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ছাড়াই অবশ্য পৃথিবীর অনেক লোকজন নামকরা হয়েছেন। হাসানুল হক ইনু বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলী। মেধাবী ছাত্র না হলে কেউ বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায় না। মেধাবী না হলে ওই পড়াশুনা কেউ করতে বা শেষ করতেও পারে না।

তবে হাসানুল হক মেধাবী ছাত্র অথবা তিনি প্রকৌশলী হোন আর যাই হোন না কেন আজকের রাজনৈতিক প্রভাবে তিনি খালেদা জিয়ার ধারেকাছেও নেই। প্রফেসর এমাজ উদ্দিন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শতশত অধ্যাপক যখন ম্যাডাম ম্যাডাম বলে খালেদার কৃপার আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন, তারা কেউ বেয়াদবের মতো জানতেও চান না, ম্যাডাম কী পাশ? এই পড়াশুনা নিয়েই খালেদা জিয়া দু’বার নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

আরেকবার নির্বাচনে ‘গলতি’ কবুল করে আওয়ামী লীগের গণ কার্ফু জাতীয় আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে কী! তিনিতো দু’বার ফুল টার্ম প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। বুয়েটের ডিগ্রী ধুয়ে হাসানুল হক ইনু তা পেরেছেন কী? অতএব খালেদা জিয়া অবশ্যই ‘মহীরুহ’ এবং তার দাবিমতো হাসানুল হক ইনু ‘পরাগাছা’ বটে!

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনু’র রাজনৈতিক উত্থান। সেই ছাত্রলীগ আজকের এই ছাত্রলীগ নয়। সেই ছাত্রলীগ বাংলাদেশ সৃষ্টির সব আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার।

আর শৈশব, কৈশোর, যৌবনে রাজনীতির ধারেকাছেও ছিলেন না আজকের ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়া। সেই সময়ে ছাত্র রাজনীতির যে প্রভাব ছিল তিনি যদি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যেতেন, নিশ্চয় তিনিও ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন অথবা এনএসএফ এর রাজনীতির সঙ্গে জড়াতেন।

একজন সেনা অফিসারের সঙ্গে যখন তার বিয়ে দেয়া হয় নিশ্চয় তখন তার বাবা-মা’র একমাত্র চাওয়া ছিল মেয়ে সুখে থাকবে। আর দশটা বাবা-মা যা চান আর কী। বিবাহিত জীবনে খালেদা জিয়া সুখে না দুঃখে ছিলেন সে বিতর্কে আমরা যাবো না।

তবে ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ বইটার মতে তিনি অভাবে ছিলেন। ওই বই অনুসারে জিয়া-খালেদা দম্পতি স্বাধীনতার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে থাকার সময় কর্নেল তাহেরের পরিবার তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন মাত্র। খালেদা জিয়া মিসেস লুৎফা তাহেরের কাছে জানতে চাইছিলেন ঢাকায় গেলে কোন মার্কেটে সস্তায় জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। সোয়ারিঘাট থেকে মাছ কিনলে সস্তায় পাওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি!

‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যিনি ধৃষ্ট উচ্চারণে ‘পরাগাছা’ বলছেন, তিনি যুদ্ধে যাননি! খালেদা জিয়ার স্বামী যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, এটাও নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেননি! যুদ্ধের সময় খালেদা জিয়াকে নিয়ে যেতে আগরতলা থেকে হাবিবুর রহমান সানি নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠিয়েছিলেন জিয়া।

সানি জিয়ার সেক্টরে কাজ করতেন। সেক্টর কমান্ডারের আদেশ। তাই তিনি ঝুঁকি নিয়ে ওই সময়ে দেশে ঢুকে সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে তার হাতে জিয়ার চিঠি দেন। স্বামীর হাতের লেখাও নিশ্চয় চিনতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এরপরও তিনি তার সঙ্গে স্বামীর কাছে যাননি! মেজর জেনারেল (অব:) নূরুল ইসলাম শিশুর ভাই। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সানি এখনো বেঁচে আছেন।

এ নিয়ে যুদ্ধের পর কী সমস্যা দেখা দিয়েছিল, খালেদা জিয়া কেন ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন, সে বিতর্কেও আমরা যাবো না। শুধু এখানে এটুক বলা যায় এসবই মুক্তিযুদ্ধে ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়া আর ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুর ভূমিকা!

এই ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুদের কাছে অবশ্য একদিন স্বামীর জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া! খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হবার পর জিয়াকে বন্দী করা হয়। তখন স্বামীকে মুক্ত আর তার জীবন রক্ষার্থে এই ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুদের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া! হাসানুল হক ইনুরা তখন তাদের এই ভাবীর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।

সরল মনে জিয়াকে মুক্ত করে উল্টো খেয়ে যান ধরা! ইনুদের বাদ দিয়ে ‘নারায়ে তাকবির’ ওয়ালাদের সঙ্গে মিশে যান জিয়া! তার জীবন রক্ষাকারী কর্নেল তাহের, ইনুদের তিনি বন্দী করেন! জিয়া-খালেদা জিয়া দম্পতি খুব ভালো মানুষ! তাই জীবন রক্ষাকারী কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া এর প্রতিদান দেন! ক্ষমতা দখলের পর জিয়া এবং তার দলের লোকজন প্রতিদিন বক্তৃতায় বলতো বাকশালের লালবাহিনী দাবড়ে দিয়ে জাসদের তিরিশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল! ক্ষমতা পেয়ে জাসদের বাকি নেতাকর্মীদের হত্যার বন্দোবস্ত করেন জিয়া! শতশত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে তখন হত্যা করা হয়।

এজন্যে কর্নেল তাহের হত্যা মামলার বিচারের রায়ে হাইকোর্ট বলেছিল, বাংলাদেশের আইনে মরণোত্তর বিচারের বিধান নেই। সে কারণে এসব হত্যাকান্ডের বিচার করা যাচ্ছে না! সেই জিয়ার উত্তরসূরী আজকের ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়া তার ভাষার ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুকে বলছেন, ‘কত মানুষ যে খুন করেছে’! সেই খুনিটা কে ম্যাডাম? জিয়া না হাসানুল হক ইনু? হাইকোর্টের রায়ে কি লেখা হয়েছে?

মুক্তিযুদ্ধসহ একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারবাহিকতায় আজকের খালেদা জিয়ার ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুর সৃষ্টি। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভুল রাজনীতির কারণে তার দলটি আজ ছোট। আর ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছেন স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে। জিয়া জীবিত থাকতে খালেদা জিয়াকে রাজনীতির ধারকাছেও আনেননি।

বিদেশ সফরে ফার্স্ট লেডি হিসাবে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কখনো দলের কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাননি। বাংলাদেশের পারিবারিক সামাজিক কাঠামোয় স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকার হন। স্বামীর পেনশন পান। খালেদা জিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন বিএনপির নেতৃত্ব। যদিও বিএনপি নেতারা শুরুতে তাকে দলের চেয়ারপার্সনের পদও দেননি! বিচারপতি সাত্তারের আমলে তাকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছিল।

আজকের ব্যারিষ্টার মওদুদসহ বিএনপির বেশিরভাগ নেতা তখন এরশাদের সঙ্গে চলে যাওয়াতে তার বিএনপির নেতৃত্বে আসা সহজ হয়। তখন অবশ্য অনেক পরিশ্রম করেছেন খালেদা জিয়া। সেনানিবাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাদা সুতি শাড়ি পরে মিছিলের সঙ্গে হেঁটে প্রেসক্লাব পর্যন্তও এসেছেন! এরশাদ আমলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আটদল যখন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে চলে গেলে‍া, এই ‘পরাগাছা’ হাসানুল হক ইনুদের নেতৃত্বের ৫ দল তখন কতোইনা আপন ছিল এই ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়ার! মাঝে মাঝে কিছু লোকজন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের একটি মিছিলে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শিরিন আখতারের একটি ছবি পোস্ট করে! এ ছবিটি এরশাদ আমলের।

এরশাদ তার পতন রুখতে একবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করেছিল। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে শহীদ মিনার থেকে বেরুনো সে মিছিলটি সেদিন প্রেসক্লাব পর্যন্ত এসেছিল। এখন যে ছবিটি পোষ্ট করা হয় এটি সেই মিছিলের ছবি।

হাসানুল হক ইনুদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সখ্যের ভাঙ্গন ধরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাসানুল হক ইনুরা ওই আন্দোলনে যোগ দেন।

আর এতে ক্ষেপে গিয়ে শহীদ জননীসহ ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেন খালেদা জিয়া! মূলতঃ তখন থেকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে ইনু-মেননদের রাজনৈতিক সখ্য চূড়ান্তভাবে ভেঙ্গে যায়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী করেন খালেদা জিয়া!

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে খালেদা জিয়ার চূড়ান্ত বিরোধ তখন থেকেই। রাজনৈতিক ‘মহীরুহ’ খালেদা জিয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত খুনিদের বিচার আটকে দেন! এরপর আর কী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সহযোগী পাঁচদলকে তিনি আর কাছাকাছি পাবার আশা করতে পারেন? কারণ হাসানুল হক ইনুসহ এই জোটের প্রধান সব নেতাইতো মুক্তিযোদ্ধা। কাজেই মুক্তিযোদ্ধারা ‘পরাগাছা’ যুদ্ধাপরাধী আর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যার কার কাছে আপন হয় তিনি কী কিসিমের ‘মহীরুহ’ বাংলাদেশের রাজনীতির?

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক সম্প্রীতির আহবান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া! আর একই বক্তৃতায় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি বলেছেন, পরাগাছা! তাই খালেদা জিয়ার এই আহবান স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রার থেকে নতুন কিছু নয়। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-হেফাজতদের নিয়ে চলবে তার রাজনৈতিক সম্প্রীতি! ‘পরাগাছা’ মুক্তিযোদ্ধারা থাকবেন তার বিপরীত মেরুতে।

খালেদা জিয়ার এই পৃথক যাত্রার ফল ভোগ করছেন তার দলের মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তানেরা। দেশে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-ফাঁসি হচ্ছে কিন্তু জনগণের সঙ্গে তারা উৎসবেও আসতে পারছে না! বিএনপি এর ফল ভোগ করছে এবং করতেই থাকবে। কারণ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এর বিপরীতে গিয়ে কারো জয়ের সুযোগ নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক ঘটনা এদেশে ঘটবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধৃষ্ট উচ্চারণে যে ‘পরাগাছা’ বলেছে, এর জবাব কী দেবে বাংলাদেশ?