ইংরেজি ২০১৬ শুরু। ভাবছেন, ইট ক্রংকিটের খাঁচায় ঘেরা যান্ত্রিক এই নগরী ছেড়ে কোনো এক প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বেড়িয়ে আসা দরকার। তাতে ছেলেমেয়েদের নগর জীবনের একঘেয়েমির কিছুটা অবসান হবে।
হ্যাঁ, শীতের এই আমেজে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় এখনই। রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ-পাহাড়, বান্দরবানের কেওক্রাডং, তাজিংডং, চিস্বুক পাহাড়, স্বর্ণ মন্দির, নীলগীরি-নীলাচল, বগা লেক, মেঘলা বা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত-ইনানী।
নতুন উদ্যমে পর্যটনের দ্বার খুলে দিয়েছে বান্দরবানের আলীকদম-লামা। যেখানে রয়েছে সাগর, আকাশ ও প্রকৃতির গভীর প্রেম, রয়েছে বন্য প্রানীদের উঁকিঝুকি আর কাছ থেকে মেঘ ছুঁয়ে দেখার অপূর্ব সুযোগ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবারিত সবুজের সমারোহ ও মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে যার আছে, সে সহজেই বাংলাদেশের পাহাড়িকন্যা বান্দরবানের লামা ও আলীকদম ঘুরে আসতে পারেন। পাহাড়ি ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা গিরিপথ, নানা প্রজাতির পশুপাখি ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য টাইটানিকের অনুরূপ লামার মিরিঞ্জা টাইটানিক পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট উঁচুতে লামার মিরিঞ্জা টাইটানিক পাহাড় দেখে মনে হয় হাজারো পাহাড়ের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজিয়ে তুলেছে এ পাহাড়কে।
রূপবতী আলীকদম
যেখানে পাহাড়ের বুকে হেলান দিয়ে আকাশ ঘুমায় সে ধরণের এক কাব্যিক মনোরম পরিবেশে মারাইংতং জেদীর অবস্থান। আলীকদম-লামা উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রায় ২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় চূড়ায় মারাইংতং স্থানটির অবস্থান। এ পাহাড় চুড়া থেকে প্রকৃতি আর নীলাকাশের সঙ্গে যে কোনো পর্যটক একাকার হয়ে যেতে পারেন।
পাহাড়চূড়া থেকে সোজা পশ্চিমে বিশ্বের বৃহত্তম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত অনায়াসে দেখা যায়। তাছাড়া সেখানে দাড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যাদি অবলোকনের পাশাপাশি এক কাব্যিক পরিবেশের ছন্দময় প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ১৬/১৭ কিলোমিটার দূরে মারাইংতং জাদীর অবস্থান। আলীকদম-লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়কের রেপারপাড়ী এলাকা থেকে পাহাড়চূড়ায় যাওয়ার রাস্তা আছে। রেপারপাড়ী থেকে দক্ষিণমুখী ইটের রাস্তা দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়চূড়ায় ওঠার জন্য রয়েছে কাঁচা মাটির রাস্তা।
এই পাহাড়চূড়াকে সর্বপ্রথম বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দৃশ্যপটে নিয়ে আসেন। ১৯৯২ সালে ১০ একর পাহাড়কে ‘মহইদই বৌদ্ধ ধাম্মা জেদী’ নামে একটি কমিটির মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে সেখানে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে আয়তাকার একটি বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয়। স্থাপিত বৌদ্ধ জাদীকে ঘিরে প্রতি বছর ‘মারাইংতং মেলা’ নামের একটি উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। উৎসবে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু ও দায়ক দায়িকার সমাগম ঘটে। প্রতি বছর এখানে ৩ দিনব্যাপী বৌদ্ধ মেলা হয়।
আলী সুড়ং
পার্বত্য উপজেলা আলীকদম সদর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই মাতামুহুরী-তৈন খাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ২ পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আলীর গুহা বা আলী সুড়ং। ঝিরি থেকে দেড়শ’ ফুট ওপরে রয়েছে গুহাটি। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে হয়রত আলী (রা:) কোনো এক সময় ওখানে অবস্থান করেছিলেন। সেখান থেকে গুহাটির নাম দেওয়া হয় আলী সুড়ং বা আলীর গুহা। তবে প্রকৃতির অপরূপ এই গুহাকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই।
পাহাড়ি ঝিরি থেকে গুহায় ওঠা খুবই কষ্টের। পাথরবেষ্টিত গুহাটিতে কিছুদিন আগেও দড়ি বা পাহাড়ের লতা ধরে আস্তে আস্তে উঠতে হতো। পর্যটকদের এই সমস্যার সমাধানে আলীকদম সেনা জোনের উদ্যোগে তিনটি সিঁড়ি বসানো হয়েছে। ফলে পর্যটকরা অনায়াসেই যেতে পারেন গুহা দর্শনে।
গুহাটি দেখতে বেশ ভয়ানক। পাহাড়ের মাঝখানে লম্বাকৃতির এই গুহাটি প্রায় ১শ’ ফুট লম্বা। তার পাশেই আরও দু’টি গুহা রয়েছে। সেগুলোও লম্বায় প্রায় একই রকম। গুহার ভেতরে অন্ধকার। টর্চলাইট বা আগুনের মশাল নিয়ে ঢুকতে হয়। তবে সাবধান, গুহার ভেতরে রয়েছে ছোট বড় চাপা বাদুর। বাদুরগুলো এদিক-ওদিক উড়ে যাওয়ার সময় ভয় পেতে পারেন। তবে কারো কোনো ক্ষতি করে না এরা। ভ্রমণ পিপাসুদের জানিয়ে রাখি, আলীকদম সেনানিবাসের কোলঘেঁষা এই আলী সুড়ং ভ্রমণে কোনো নিরাপত্তাহীনতার ভয় নেই।
গার্ডেন তুলি ও ডিম পাহাড়
দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক আলীকদম-থানচি সড়ক। আলীকদম থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ওই রাস্তার পাশেই গার্ডেন তুলির অবস্থান। যেখানে দাঁড়ালে দার্জিলিং উপভোগ করা যায় অনায়াসেই। এর আশপাশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ম্রোদের দলবদ্ধ বসবাস।
গার্ডেন তুলি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে থানচি-আলীকদম সীমান্তে ডিমের আকৃতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ এক পাহাড়। যাকে স্থানীয়রা ডিম পাহাড় বলেই চেনে। এই পাহাড়চূড়ায় দাঁড়ালে দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের উত্তাল জলরাশি আর বাঁধভাঙা ঢেউ, পূর্বে মিয়ানমারের মৌন পাহাড় (কালো পাহাড়) আর চারদিকে প্রকৃতির মাদুর বিছানো সবুজের সমারোহ। পড়ন্ত বিকালে এই পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটু হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় দল বেঁধে ভেসে চলা মেঘদলকে।
পোয়ামুহুরী ঝর্ণা
আলীকদম সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পোয়ামুহুরী ঝর্ণায় যেতে পারেন নৌকায় বা পায়ে হেঁটে। আলীকদম বাজার সংলগ্ন মাতামুহুরী নদীতে রয়েছে ইঞ্জিনচালিত বা পালতোলা নৌকা। তবে এই নৌকা সুবিধাটি পাবেন শুধু বর্ষা মৌসুমে। গ্রীষ্ম বা শীতে যেতে হবে পায়ের উপর ভরসা করেই।
পায়ে হেঁটে যেতে হলে আলীকদম সেনা জোন সংলগ্ন মাতামুহুরী ব্রিজ হয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ও নদীর কূল ঘেষেই হাঁটতে হবে। প্রায় একদিন হেঁটে পৌঁছাবেন ওখানে। তবে ওখানে থাকার জায়গা হলো ছোট্ট বাজার বা ম্রো সম্প্রদায়ের মাচাং ঘর।
দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক
পাহাড়ের পাদদেশের মাঝখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে সেনাবাহিনীর র্নিমাণ প্রকৌশল বিভাগ টানা এক যুগ কাজ করে নির্মাণ করেছেন বান্দরবানের আলীকদম-থানচি সড়কপথ। আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ বেয়েই যাওয়া যাচ্ছে এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায়।
পাহাড়ি পথ ধরে যখন আপনি এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় পাড়ি দেবেন, তখন আপনার মনে হবে, এখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে? না, মেঘ আপনাকে গ্রাস করছে? তখন বুঝতে পারবেন মেঘের সাথে আপনি আলিঙ্গন করছেন। আবার আপনি যখন পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠবেন, দেখতে পাবেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের উত্তাল জলরাশির বাঁধভাঙ্গা ঢেউ। আসুন, দেখে যান বান্দরবানের থানচি আবার থানচি থেকে আলীকদম পার্বত্য সৌন্দর্যের নৈস্বর্গিক বান্দরবান।
এছাড়াও, অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা-ঝিরি আর চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ উপজেলাকে সাজিয়েছে এক রূপবতী ললনার রূপে। এখানকার তৈন খাল সংলগ্ন তামাং ঝিরি ঝর্ণা, পালংখ্যাং জলপ্রপাত সৌন্দর্যকে করেছে আরও রূপময়। যা মনের অজান্তেই যে কোনো ভ্রমণ পিয়াসীর মনে শিহরণ জাগাবে অনায়াসে।
তবে এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখনো রয়ে গেছে সরকারের অবহেলায়। পর্যটন কর্পোরেশন, পর্যটন মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে নতুন উদ্যোগে সাজানোর কোনো সুসংবাদ আজও দিতে পারেনি। স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি আলীকদম ও লামার এ ২ উপজেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর প্রচার ও উন্নয়নে সরকার উদ্যোগী হলে রূপবতী লামা-আলীকদম হবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন নগরী। তার সঙ্গে সরকারও পাবে অনেক রাজস্ব।