হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে শহীদ হওয়া বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন জঙ্গিদের ছোঁড়া গ্রেনেডে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে একটি ভবনের গেটের সামনে পড়ে ছিলেন। সেসময় তার শরীর থেকে প্রচণ্ড রক্তপাত হচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মুমূর্ষু ও্ই পুলিশ কর্মকর্তার দিকে নজর দেওয়ার সময়ও ছিল না। অন্তত ১৫-২০ মিনিট তিনি এভাবেই পড়ে ছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই ঘটনায় আহত গুলশান মডেল থানার তৎকালীন ওসি সিরাজুল ইসলাম। তিনি নিজেও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই গ্রেনেডের স্প্লিন্টার।
এখন রাজধানীর চকবাজার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের (এসি) দায়িত্বে থাকা সিরাজুল ইসলাম ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: জঙ্গিদের গ্রেনেডে আমি আহত হওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের গাড়ির গ্যারেজে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেসময় আমার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। মাহবুব নামে এক পুলিশ সদস্য তার গায়ের গেঞ্জি ছিঁড়ে আমার দুই পায়ে বেঁধে দেয়।
‘আমার থেকে ৫-৭ গজ দূরে গেটের বাইরে দেখলাম সালাউদ্দিন (বনানী থানার তৎকালীন ওসি এবং ওই হামলায় নিহত) পড়ে আছে। তখনও গোলাগুলি হচ্ছিল, শব্দ আসছিল। তাই কেউ আর মুমূর্ষু সালাউদ্দিনের কাছে যেতে পারেনি। যাওয়ার মতো পরিবেশও ছিল না। এ অবস্থায় প্রায় ১৫-২০ মিনিট সে ওভাবেই পড়ে ছিল।’
এরপর গাড়িতে করে ওসি সালাউদ্দিন এবং সিরাজুল ইসলামকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সিরাজুল ইসলাম পরে সুস্থ হয়ে উঠলেও বাঁচানো যায়নি সালাউদ্দিনকে। ওই ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এর সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও শহীদ হন।
গুলশান মডেল থানার ওসি হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সিরাজুল ইসলামই প্রথম ওই ঘটনার খবর পান। সেদিনকার পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন: রাত আনুমানিক পৌনে ৯টায় আমি টেলিফোনে খবর পাই যে গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডে গোলাগুলি হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ওই এলাকার মোবাইল অফিসারকে বেতারযোগে নির্দেশ দেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য। আমি নিজেও যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে ছিল এসআই খালিদ এবং কনস্টেবল মানিক।
‘গুলশান মোড়ে যাওয়ার পর থেকে আমি গুলির শব্দ শুনছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেনেডের শব্দ শুনতে পাই। গ্রেনেডের শব্দ শুনে মানিক এবং খালিদকে নিয়ে আমরা গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যাই। কাছাকাছি যাওয়ার পর এসআই রাকিব এলো। লেকভিউ ক্লিনিকে ঢোকার সময় ডানপাশে যে বহুতল ভবন তার ছাদে গেলাম আমরা সবাই।’
ওই সময়ের হলি আর্টিজানের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন: ছাদে গিয়ে আমরা দেখলাম হলি আর্টিজানের বারান্দায় কয়েকজন হাঁটাহাঁটি করছে। এরপর হলি আর্টিজান থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে আমরাও পাল্টা গুলি ছুঁড়ি। কিছুক্ষণ পর হলি আর্টিজানের বারান্দার লাইট বন্ধ হয়ে যায়। ভেতর থেকে আসা আলোতে দেখছিলাম একজন লোক বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে।
ওই হামলা যে পরিকল্পিত জঙ্গি হামলা ছিল তা প্রথমে ধারণা করতে পারেনি পুলিশ। এরপর উপর্যপুরি গুলি ও গ্রেনেড ছোঁড়া এবং হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শুনে তারা নিশ্চিত হন যে এটি জঙ্গিদের হামলা।
‘‘আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি যে এটা জঙ্গি হামলা। ভেবেছিলাম উচ্ছৃঙ্খল ছেলেপেলে হয়তো খেয়েদেয়ে বিশৃঙ্খলা করছে। কিন্তু যখন গুলি ও গ্রেনেড ছুঁড়ছিল এবং আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিচ্ছিল তখন বুঝতে পারি যে এরা জঙ্গি।’’
জঙ্গি হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর
ওই ঘটনা যে জঙ্গি হামলা ছিল তা নিশ্চিত হওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপের বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বলেন: নিশ্চিত হওয়ার পর আমি ওয়ারলেসে সংশ্লিষ্ট সব অফিসারকে জানালাম। গুলশান জোনের ডিসিকে (মোস্তাক আহমেদ) জানালাম যে স্যার, আমার অতিরিক্ত ফোর্সের দরকার। তাকে এও জানালাম যে ভেতর থেকে তারা ‘আল্লাহ আকবর’ ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি দিচ্ছে। তখন স্যার (ডিসি) বুঝতে পারলেন। তিনি আমাদের নীচে নামতে বললেন। নীচে নামার পর আরও উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এলেন। একপর্যায়ে আমরা লেকভিউয়ের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঢোকার পরে তারা আর কোন গুলি বা গ্রেনেড ছোঁড়েনি। ভেতরে ঢুকে ডিসি স্যার এক দুই মিনিট পর্যবেক্ষণ করে আমাদের বললেন, চলো আমরা বাইরে গিয়ে পরিকল্পনা করি।
“গেট থেকে বের হওয়া মাত্রই নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে জঙ্গিরা। এতে সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম, বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন, গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলামসহ পুলিশ, আনসার ও গোয়েন্দা বাহিনীর অন্তত ৩২ জন আহত হন।”
সিরাজুল ইসলাম বলেন: গেট থেকে বের হয়ে তিন-চার গজ সামনে যেতেই পেছন থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে। গ্রেনেডে আমি, আমার বডিগার্ড, মানিক ও খালিদ আহত হয়। ওই এক গ্রেনেডে পুলিশ-আনসার-গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৩২ জন আহত হয়। আমি আহত হওয়ার পর হামাগুঁড়ি দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের গাড়ির গ্যারেজে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেসময় আমার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। মাহবুব নামে এক পুলিশ সদস্য তার গায়ের গেঞ্জিটা ছিঁড়ে আমার দুই পায়ে বেঁধে দেয়।
আহত সিরাজুল ইসলামের পাশেই মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিলেন সালাউদ্দিন, যিনি পরে মারা যান। এছাড়াও নিহত হন সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম।
বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম বলেন: আমি প্রথমে এক সপ্তাহ ইউনাইডেট হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, পরে সিএমএইচ থেকে এক মাসের মতো চিকিৎসা নিয়েছি। আমার গায়ে এখনও ৬-৭টি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। তার মধ্যে দুটি খুব বেদনাদায়ক।
হামলার ঘটনা জানার পর হলি আর্টিজান যে থানার অধীনে সেই থানার প্রস্তুতি সম্পর্কে তৎকালীন ওসি বলেন: যখন যেটা সামনে আসে আমরা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করার চেষ্টা করি। প্রথমে জানতামও না যে ওখানকার (হলি আর্টিজান) প্রকৃত অবস্থা কী। তাই আমি একজন কনস্টেবল এবং একজন দারোগাকে নিয়ে প্রথমে মুভ করি। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর একটি মোবাইল টিম আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
পুলিশের বাধায় জঙ্গিরা হলি আর্টিজান থেকে পালাতে পারেনি
সিরাজুল ইসলামের ধারণা, জঙ্গিরা প্রথমে ঢুকেই দেশি-বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে ফেলে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময় পুলিশ বাধা দিলে তারা ভেতরে ঢুকে যায়। তা না হলে তারা বেরিয়ে যেতে পারতো এবং ওই ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হতো না।
দেশ ও জাতির স্বার্থে পুলিশের ওই অবদানকে অত্যন্ত হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে দেখেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে গুলশানের ওই হামলা এবং তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানির থেকে পুলিশ বাহিনীর একটি শিক্ষা হয়েছে বলে মনে করেন সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন: ওই ঘটনার পর থেকে আমাদের এক ধরনের ধারণা জন্মেছে। এখন এ ধরনের ঘটনার খবর পেলে আমরা পূর্ণ প্রস্তুত (ওয়েল ইকুইপড) হয়ে যাই।
চকবাজার জোনের এসির ধারণা, জঙ্গিরা আর বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
তিনি বলেন: আমরা হয়তো শতভাগ জঙ্গিদের মূলোৎপাটন করতে পারিনি। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের তেমন কেউ আর বেঁচে নেই। পালিয়ে কেউ আছে হয়তো। কিন্তু যারা আছে তাদের পক্ষে আর হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ ওই ধরনের সক্ষমতা তাদের আর নেই।