হলি আর্টিজান: সাংবাদিকদের বর্ণনায় সেই রাতের চিত্র
জুলাই ১, ২০১৬। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় পেশাজীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ কাভারেজের রাতটি এখনও ভাবিয়ে তোলে সাংবাদিকদের। প্রথমে হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়টা শুনে অনেকেই মনে করেছিলেন, ঈদের আগে কোন চাঁদাবজির ঘটনা। কিন্তু, অল্পক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিকরা বুঝতে পারেন, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছেন তারা। সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশ সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনা, ভেতরে আটকে পড়াদের ক্ষুদে বার্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে তারা বুঝতে পারেন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ!
তবে সেই অন্ধকার রাতে ভেতরে ঠিক কী ঘটছিল তা বুঝা খুব সহজ ছিল না। অন্ধকার রাতে অন্ধকারে থেকেই কাজ করতে হচ্ছিল তাদের। পুরো দেশের মানুষদের মতো সাংবাদিকদের জন্যও পুরো রাতটাই ছিলো উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার এক রাত।
সেসময় ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিক এবং সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। তাদের কথায় উঠে এসেছে ভয়াবহ সে রাতের বর্ণনা, তথ্য সংগ্রহের সংকটসহ সাংবাদিকতা পেশার এক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়।
পেশাজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ রাতটির বর্ণনা দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি জুলফিকার আলি মাণিক বলেন: ইফতারের পর আমার কাছে একটা ফোন আসে, গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে গোলাগুলি হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলাম যেহেতু সামনে ঈদ তাই সম্ভবত সেটা কোন চাঁদাবাজির ঘটনা। পরে আবার ফোন আসে, জানতে চাওয়া হয়– এটা কোন সন্ত্রাসী হামলা কিনা। মাথার ভেতরে দুশ্চিন্তা ঢুকে যায়। তখনই বেরিয়ে পড়ি গুলশানের উদ্দেশে।
খোঁজখবর করতে গিয়ে তিনি দেখেন বিষয়টা নিয়ে কেউ কোন তথ্য দিতে পারছেন না। সবাই সন্দিহান। এর কিছু পরে জানতে পারেন সন্ত্রাসীদের ধরতে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আহত-নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই গুলশান-বনানী পুরো এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষের যাতায়াতে নিয়ণ্ত্রণও আরোপ করা হয়েছে।
‘আমি পৌঁছানোর আগে প্রথম দফা গোলাগুলি হয়েছে। ঘটনাস্থলে আমি যখন পৌঁছেছি তখন ১০.৩০টা বেজে গেছে। গিয়ে দেখি পুলিশ আর সাংবাদিকের ভীড়।’
মাণিক শুরুতেই ছুটে যান ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে খোঁজ করতে থাকেন আহত-নিহতদের। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মৃত্যু তাকে বুঝিয়ে দেয়, ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সঠিক তথ্য পাওয়া ছিল দুরূহ। বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় পুলিশও মুখ খুলছিল না। সেসময় পর্যন্ত পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২০ জনের মতো সদস্য আহত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন: পুলিশ এটাকে জঙ্গি হামলা বলে মনে করছিল, কারণ আক্রমণের আগে ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। প্রথমবার আক্রমণের পর পুলিশ আর ভেতরে যেতে পারেনি। তখন জানার চেষ্টা করতে থাকলাম ভেতরে কতজন সন্ত্রাসী অাছে। সেসময় সঠিক তথ্য পাওয়াটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।
‘এর মধ্যে খবর আসে আইএস হামলায় দায় স্বীকার করেছে, তারা ২০ জনকে মেরে ফেলেছে। অন্ধকার রাতে আমরাও সেসময় অন্ধকারের মধ্যেই কাজ করছিলাম।’
আশপাশের চিত্র বর্ণনা করে জুলফিকার আলি মাণিক বলেন: দেখতে পেলাম সাংবাদিক ও পুলিশের বাইরে সেখানে কিছু লোক অবস্থান করছিল। এরা সবাই ছিল ভেতরে আটকে পড়াদের স্বজন। এর ভেতরে কয়েকজন দেশী, কয়েকজন আবার ফরেনার। সেখান থেকে ভেতরের কিছু তথ্য পেলাম।
সেসময় সাংবাদিক মাণিক খুঁজে পান এমন একজনকে যিনি একসময় ওই রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। ‘তার এক কাজিন ভেতরে অাটকে ছিল। দেখলাম সে তার কাজিনের সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাটিং এর মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করছে। সেখান থেকে আমি অনেক কিছু জানতে পারলাম ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে। ততক্ষণে অলরেডি ভোর হয়ে গেছে। তীব্র উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে পার হয় সে রাতটি।’
অন্যদের মতো মাণিক জানতে পারেন সিলেট থেকে কমান্ডো দল আসছে। এর মধ্যে সেখানে আর্মির গাড়িও আসতে শুরু করেছে। ‘তখন আর বুঝতে বাকি নেই অভিযান শুরু হবে।’
সেসময় সাংবাদিকদের একদিকে সরিয়ে দেয়া হয়। ভোরের অালো ফোটার সময় কিছু বিদেশী আসা শুরু করেন। ‘তাদের সঙ্গে কথা বলি শুরু করি। তাদের চোখে মুখে তখন ভয়, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক। কতজনকে জীবত ফেরৎ পাওয়া যাবে তা নিয়ে শঙ্কা।’
‘আর্মি অভিযান শুরু হলো ৭.৩০টার দিকে। গুলির আওয়াজ শুরু হয়। আকাশ কাঁপানো বিকট শব্দ হচ্ছিল। এত জোরে শব্দ হচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল গুলি আমাদের দিকে আসছে। টানা ৪০ মিনিট ধরে এ শব্দ চলতে থাকে।’
‘চল্লিশ মিনিট পর শেষ হয় অভিযান। অভিযান শেষে পুলিশের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারলাম, সবুজ লনে পাঁচ সন্ত্রাসীর লাশ পড়ে আছে। এরপর ক্যান্টনমেন্টে প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে জানতে পারলাম সবকিছু।’
জুলফিকার আলি মাণিকের মতোই অভিজ্ঞতা বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর। তিনি তখন মানবজমিন পত্রিকায় ছিলেন। রাত পৌনে ৯টার একটু পর লাবুর মুঠোফোনে একটি কল আসে। জানতে পারেন গুলশানের হলি আর্টিজান রেঁস্তোরায় গোলাগুলি হচ্ছে।
সেসময় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন। তবে, এরইমধ্যে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক কর্মকর্তা তাকে জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে বড় ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসী ঢুকেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই আছে সেখানে।
‘শোনামাত্রই ছুটে যাই। গুলশানের শ্যুটিং ক্লাবের কাছে গিয়ে দেখি সব রাস্তা বন্ধ। গুলশান এলাকা থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না আবার ভেতরেও যেতে দিচ্ছে না কাউকে। অনেক বুঝিয়ে নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ১০.৩০টার দিকে গেলাম সেখানে। গিয়েই দেখতে পেলাম বিস্ফোরণে আহত লোকজন। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আহত। বুঝলাম এটা একটা বড় ঘটনা। চারিদিকে ফিসফাস শুনলাম, এটা জঙ্গি হামলা হতে পারে। ভেতরে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে রেখেছে সন্ত্রাসীরা। তবে বিষয়টা কারো কাছেই স্পষ্ট ছিল না। তখন আমি চৌরাস্তার কাছাকাছি ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনের প্রস্তুতি। মধ্যরাত পর্যন্ত এভাবে যায়।’
পুলিশ সেসময় সাংবাদিকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। ‘এর মধ্যে জানতে পারি অপারেশন হবে ভোরের আলো ফোটার পর। অপারেশন করতে সিলেট থেকে আসবে সেনা কমান্ডো। জানতে পারি, বেকারির ছাদে মাঝে মাঝে দু’একজনকে দেখা যাচ্ছে। এরই মাঝে শুরু হয় বৃষ্টি।’
রমযান মাস, মধ্যরাত, তার ওপরে আবার বৃষ্টি। ভেতরে কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে সব মিলিয়ে খুব আতঙ্কিত সময় কাটছিলো সাংবাদিকদের। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য একটা বাড়ির গ্যারেজে আশ্রয় নেন তিনি। সেখানে দেখা মেলে দু’জন সহকারি পুলিশ কমিশনারের। তাদের কাছ থেকে ঘটনার কিছু বর্ণনা পান। বৃষ্টি কমে আসার পর বের হলে তখন আর চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে দেয়া হচ্ছিল না লাবুসহ অন্যান্য সাংবাদিকদের।
‘কিন্তু আমার মাথায় তখন একটা বিষয়ই কাজ করছিল– কাছাকাছি কোন অবস্থানে থেকে আমাকে পুরো বিষয়টা কভার করতে হবে। সেমসয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডে বোঝা যাচ্ছিল যে অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল বারবার দুরে সরে যাবার জন্য। আমি তাদের চোখকে ফাঁকি দিযে ফায়ার সার্ভিসের একটা গাড়ির পেছনে বসি। সেখানে আরও কয়েকজন রিপোর্টারের সঙ্গে দেখা হয়। একটু পর আবার বৃষ্টি শুরু হয়।’
বৃষ্টি থেমে গেলে লাবু কৌশলে চলে যান চৌরাস্তায়। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখতে পান। লাবু নিজেও ঠিক তাদের পাশে গিয়ে তাদের মতো করেই অবস্থান নেন। নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
তিনি বলেন: ৭.২০ এর দিকে দেখতে পাই সেনাবিাহিনীর কিছু জিপ আসছে। সেখান থেকে আর্মি কমান্ডোদের নামতে দেখতে পেলাম। তখন বুঝতে পারি, কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশন শুরু হবে। সেসময় উত্তেজনায় আমার হাত-পাঁ কাপছিল। মোবাইলের ভিডিও বাটন ওপেন করতেও ভয় পাচ্ছিলাম। প্রথম গাড়িটা ছিলে আমার থেকে দশ হাত সামনে। এরইমধ্যে নির্দেশ পাওয়া মাত্র সেনা কমান্ডোদের দুটো দল দু’পাশের ফুটপাত দিয়ে এগোতে শুরু করলো হাঁটু গেড়ে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই কামানটা যে ধরে রেখেছিল সে লাফ দিয়ে উঠল।
‘আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি হলিউডের কোন সিনেমা দেখছি। এর মাঝে দেখতে পেলাম হাসনাত করিম তার ওয়াইফ, দুই বাচ্চা, একজন আহত জাপানি নাগরিক ও তাহমিদ বের হয়ে আসছে। সবার আগে বের হয়েছিল তাহমিদের দুই বান্ধবী।’
তাদেরকে উদ্ধার কর পাশের একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা বেরোনোর পরপরই শুরু হয় গুলির আওয়াজ। গুলির শব্দে মনে হচ্ছিল বিল্ডিং কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছিল ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়ার কোন যুদ্ধ।
‘যা আমরা টিভিতে দেখি তা এখন চোখের সামনে দেখছি। প্রায় ৪০ মিনিট পর গুলির আওয়াজ থেমে যায়। সেনাপ্রধান, আইজিপি, র্যাব ডিজিসহ সবাই তখন রেঁস্তোরার ভেতরের মাঠে যান। এরপর পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারি ২০, ২২ বা ২৪ জন মারা গেছে। দুপুরে আইএসপিআর থেকে ব্রিফ করা হয়।’
লাবু বলেন, সাংবাদিকতা জীবনে এটা খুবই দুর্লভ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি একটি বই লিখেছেন– হলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান।