বলি, শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে ॥
ফিরে ফিরে আসে শ্রাবণ, প্রতি বছর, বাংলায়।
ফিরে আসে বাকরুদ্ধ সময়; ফিরে আসে স্মৃতি-বিস্মৃতি; ফিরে আসে স্বপ্ন; ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-আমৃত্যু আমাদের মুজিবুর ফিরে আসে বাংলায়, বাদল দিনে, শ্রাবণে; ফিরে আসে রক্ত ডোবানো, অশ্রুময় অক্ষরমালা,-বলব, বারিধি মুদ্রণ।
বারিধি মুদ্রণের অপর নাম ইমেজ হয়ে থাকে শ্রাবণ প্রকাশনী।
রাগী- বৈরাগী রবীন আহসান। বই ছাপেন না, তিনি বিষয় প্রকাশ করে চলেছেন,- তিনি মুদ্রার মতন মুদ্রণ করে চলেই চলেছেন, তাও তো নয় একেবারেই। অক্ষরময় বিষয়-অনবরত ধারাপাত, শ্রাবণ রাতে আমাদের বৃষ্টিময় করে তোলে।
শ্রাবণ এখানে বৃষ্টিধারার মতো অনর্গল অক্ষর হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। অক্ষর তব শব্দিত বৃষ্টি। জানার মাঝে অজানারে করি সন্ধান বিপুল বিস্ময়ে।
অশত্থ পল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মর শব্দে
নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া।
মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
ভাসায় স্বপ্ন পারাবারে-
নাহি তার কিনারা।
যেহেতু শ্রাবণ-অতএব বরষা; আবার, কী ফুল ঝড়িল বিপুল অন্ধকারে এবং এ যে বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যা বেলা। ফুল ঝরে পড়েছিল ভোরবেলা ৭৫-এ।
বইটি, দুই মলাটে বন্দি অক্ষরমালা আজলা ভরে হাতে তুলে নেবার পর বৃষ্টিসজল বিষন্ন নিশ্বাসে যেন নিখিলের সন্তাপ।
বৃষ্টি নামল তিমির নিবিড় রাতে। প্লাবন-ঢালা শ্রাবণ ধারাপাতে-তিমির নিবিড় রাতে।
আমার দেহের সীমা গেল পেরিয়ে। বুকের মাঝে বজ্র বাজে।
শ্রাবণ রাতে বাদল-বাউল বাজায় একতারা। বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে।
একে একে পাতা উল্টে চলি। শাদা পৃষ্ঠায় কালো হরফ। শুভ্র কাফনে যেন শোক চিহ্ন।
বৃষ্টির করুণ সংগীতে মন এখন
ছুটে যায় রক্তবরণ সেই প্রভাতে যখন আমাদের স্বপ্ন লুট হয়ে যায়। বর্ণহীন হয়ে যায় বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন।
স্মরণ হয়, ১৯৭৫ সাল, দিনটি ১৫ আগস্ট। নিহত হলেন জনক আগামেনন। কবরে আজ শায়িত আছেন তিনি টুঙ্গীপাড়ায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, সেই অলুক্ষুণে বারে কেবল জাতির জাগ্রত প্রতীককে ধ্বংশ করা হয় নাই বরং সেই থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব হতমান হয়েছিল।
বাংলার ইতিহাস পূর্ণ হয়ে আছে নাশকতা, ষড়যন্ত্র, হত্যা, বিশ্বাসঘাতকতায় যতখানি তার চেয়ে কম এই জাতির সাফল্যকথা; ইতিহাসের পাতা ভারি হয়ে আছে কুচক্র ও দুষ্ক্রীতির প্রবল চাপে,- তাই লড়াই ও সংগ্রামের অতি তপ্ত দিন দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর এবং সাক্ষাত বিজয় ও সাফল্য অনতিদীর্ঘ।
জাহিদ নেওয়াজ খান রচনা করেছেন এবং রবীন আহসান তার শ্রাবণ প্রকাশনী হতে ছেপে বের করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল।
এই প্রকাশিত গ্রন্থের তাৎপর্য আরও অধিক এ কারণে যে প্রাসঙ্গিকতা- লালবাতি সতর্কতা অতীতকে বর্তমানরূপে দেখা এবং ঘটমান বর্তমানকে ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে।
প্রাসঙ্গিকতা দাখিল করার মধ্যে যে চিত্রটা দেখতে পাওয়া যায়, তা হচ্ছে, দেশরক্ষা বাহিনী অর্থ বাণিজ্যে ব্যাঙ্ক, শিক্ষা ব্যবসায় বিশ্ববিদ্যালয় হতে পরিবহন খাতে নিয়োজিত যা অভূতপূর্ব। এমন কি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য অশান্তির পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণে বিদেশী মিশনে- অগস্ত্য যাত্রা বললে ভুল হবে না। অর্থকরী অবস্থান জনিত সেনাদলের অন্যত্র মনোযোগ ও অর্থনীতিক ও সম্ভাবনা ধারণ করায় প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা তৎপরতা কতখানি উদ্যমী ও সক্ষমতা সহযোগে সঠিক মানে প্রবাহিত ও যথাযথ বৈশিষ্ট্যম-িত রয়েছে, বিপদ আপদের আগাম বার্তা যথাযথ স্থানে পৌছে দেয়া এবং কতটা দ্রুততম সময় সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণেও পেশাদারীত্ব প্রয়োগে দ্বিধাহীন সেজন্য মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতি কিংবা অধিকতর পরি-লিপ্ত ও ক্ষিপ্রতায় পারঙ্গমতা লক্ষ্যভেদী কিনা- এই বিবেচনার অনন্য এক পারমিতা এবং প্রয়োজনীয় পাঠকৃতি এই গ্রন্থের ভূমিকায় নেপথ্য সংলাপ বললে ভুল হবে না। দেশরক্ষা বাহিনীর বর্তমান চেতনার বিপরীতে পাহারাদার বিশেষ। অতীতকে অতিক্রম করে বর্তমান পর্যন্ত এমনকি ভবিষ্যত পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে আছে গ্রন্থটির বিষয়বস্তু।
জাহিদ নেওয়াজ খান, সাংবাদিক ও কথক, বরফের তাপকে তিনি শব্দ ও ধ্বনিতে প্রকাশ করেছেন। শব্দ (sound & Words) দিয়ে যে অর্থকথন তৈরি করেছেন, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের অনিবার্য অভিধান। শব্দের মন্ত্রশক্তির ওপর তিনি আস্থা রেখেছেন, সেজন্য বলা যায় যে,- এক মুজিব লোকান্তরে/ লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে, সকলের স্মরণ হবে।
শব্দের জাদু শক্তি আরেকবার প্রমাণ করেছেন যেখানে জড়িত থাকে আমাদের মঙ্গল অমঙ্গল।
শব্দ নিয়ে বলবার আছে এই কারণে যে, কথকের অভিপ্রায় বিচার করা যায়। যা কথিত হয়, তা অবলম্বন করে শ্রুতিকে এবং অবশেষে লিখিত ও পঠিত হয়; এই গ্রন্থে তেমনি সাক্ষাত পাওয়া যায়।
দেশপ্রেমিক ও দেশ বিরোধীদের রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা লাভের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কভার করতে গিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আর জেরার প্রশ্নোত্তরে দেশের রাষ্ট্রশক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক ও গোয়েন্দা যে ব্যর্থতা তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবার- প্রয়াস পেয়েছেন।
পুরো প্রক্রিয়াটিই আমি রিপোর্টার হিসেবে কাভার করেছি এর দলিল দস্তাবেজ যেমন” ছিল তেমনি নোটও ছিল অনেক।
হত্যাকারীদের গ্রেফতারের সময় থেকে রিপোর্টারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। খুনিদের গ্রেপ্তার, রিমান্ড, জিজ্ঞাসাবাদ, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে বিচার, আদালতে সাক্ষ্য ও জেরার নোট, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির বিবরণ, বিচারিক আদালতে বিচার ও রায় ও পরে ডেথ রেফােেন্সর পেপার বুক পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত উৎস থেকে রচনা করেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল।
আমাদের আগামীদিনের সাংবাদিকতা যে মাধ্যমকে ঘিরে নতুন মোড় নেবে,- বিদ্যমান সেই অনলাইন প্রচার মাধ্যম, জনগণের সংবাদমাধ্যম হিসেবে প্রবল বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা নিউজ পোর্টালে অনবরত ব্রেকিং নিউজের তথ্য স্নানের ঘেরাটোপের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন পরিবেশন করেছিলেন বছর পূর্বে। সেই ধারাবাহিক প্রতিবেদন যেন চোখে আঙুল দিয়ে বলেছিল, কেন প্রতিবেদন হয়ে ওঠে স্টোরি। নিউজ স্টোরি থেকে মুদ্রিত গ্রন্থে বিষয়বস্তু সংহত করবার জন্য ঘরে বসে হলেও গবেষণা করতে হয়েছে। তার কথায় এটি গবেষণা নয় বরং তথ্য ও সংবাদ বিশ্লেষণ হিসেবে দায়বদ্ধ।
এখানে কেবল একটি পক্ষপাতিত্ব ছিল, একজন রাষ্ট্রপতি, যিনি আমাদের, স্বাধীনতার স্থপতি, সেই প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় যাদের দায়িত্ব ছিল তাদের ব্যর্থতার দায়ভার নিরূপন করা এবং সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা।
নিঃসন্দেহে এই গ্রন্থ অনেক অজানাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছে যা ভবিষ্যতের পরিসরে পাথেয় হয়ে থাকবে।
জাহিদ নেওয়াজ খান লিখলেন এবং রবীন আহসানের শ্রাবণ প্রকাশনীর হাত ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ অবলোকন, উপলব্ধি, চেতনা ও মর্মকথা এবং আলোচনা স্থায়ী রূপ লাভ করলো। দৃঢ় মূল ভিত্তি অর্জন দরকার ছিল কেননা মানুষ এযাবত নিশ্চিত ও সত্য উন্মোচন যথার্থ উপলব্ধি ও বিশ্বাসের জন্য নিশ্বাস নিতে ছাপার অক্ষরের ওপর নির্ভরশীল। গ্রন্থের পরিসরে বাক্য নির্দেশিত অর্থ আমাদের মধ্যে গুরুত্ব আবাহন করে।
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন,- ভাষা দুইভাবে ভাজ করে : একদিকে সে খবর দেয়, অন্যদিকে সে জাগিয়ে তোলে।”…
ভাব প্রকাশের বাহন হচ্ছে ভাষা। এই গ্রন্থটি ভাষার কাজ সেভাবেই হয়েছে। ফলে গ্রন্থটিও দুইভাবে কাজ করেছে। একদিকে এখানে নানা প্রকার খবর, বিভিন্ন প্রশ্ন ও তার উত্তর অন্বেষণ; অন্যদিকে পাঠকের মধ্যে বিচারবোধ, ঔচিত্য, শাদা-কালো পার্থক্য নিরূপণ ও অস্পষ্টতা থেকে স্পষ্টতা ও সত্যান্বেষণের মধ্য দিয়ে উন্নত চেতনার আস্বাদ করার প্রয়াস।
এই গ্রন্থে শব্দ চিহ্ন, ভাষাচিত্র, জোরালো আলোকপাত অনন্য এক যুক্তি-শৃঙ্খলের কুশলী পরম্পরায় সাজিয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিফলিত করেছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিপর্যয়কাল থেকে উত্তরণ পর্বের পদধ্বনিকে, লক্ষ্য ও অর্জনকে।
এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে পরিক্রমণে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে, এই হত্যাকা- কেবল গোয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতার কলঙ্ক সবেমাত্র নয় বরং তাতে মিলে গেছে হত্যাকর্মের প্রতি অশুভ প্রণোদনা। সেনা প্রধানকে ঠুটো হিসেবে দেখা যায়, সেই সুযোগে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে খুনিদের পক্ষ নিয়ে ছিল ওসমানী, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী সেনাদের সেবা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের এই সর্বাধিনায়ক,- যে কিনা বিড়ালের মত গুম্ফধারী বলেই হয় তো ধূর্ততায় গণ্যমান্য।
হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ মনে পড়তে বাধ্য করবে আমাদের।
‘একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়।’
হুমায়ুন আজাদ যথার্থ উপলব্ধি হতেই সংহতভাবে প্রকাশ করেছিলেন সত্য, তা থেকে সাধারণ সূত্র।
অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী, রাজাকার পুনর্বাসনে অকুতোভয় জেনারেল জিয়া রহস্যময় ভূমিকা পালন করেছিল বললে ভুল হয় বরং সাক্ষ্য-উপাত্ত জানান দেয় যে, মুজিব হত্যাকারী খুনী ফারুক-রশীদের স্পর্ধার পেছনে উসকানি দাতা প্রধান নাটের গুরু ছিল জিয়াউর রহমান। এই গ্রন্থের বিধৃত হয়েছে, ফারুক-রশিদদের জন্য ছিল তার অফুরন্ত ভালোবাসা। খুনিদের বিদেশে প্রেরণ, ক্ষমতারোহনের পর সিংহাসনকে সুরক্ষিত রাখতে স্বাধীনতা বিরোধীদের অন্যান্য উচ্চপদে সমাসীন করা, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা, দালাল আইনে বন্দি সব অপরাধীদের খালাস ও আইনটিকে বাতিল করা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দায়মুক্তির আইনকে শিরোধার্য রেখে প্রকারান্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব হরণের মুশতাকের কাঁধ বেয়ে যে কফিন সময়কে গতিহীন করে দিচ্ছিল সেই কফিনকে সম্পূর্ণ অবয়বদানে শেষ পেরেকে মারা সম্পন্ন হয় জিয়ার করকমলে। বাংলাদেশকে পাকিস্তনি নকশায় যেন বাংলাস্তান করা,- মননে ও জননে সম্পন্ন করেছিল বলেই পাকসেনারা যা করতে পারে নাই, রাজাকারদেরও কল্পনার অতীত ছিল- সেই কৃতকর্মটি লেজে খেলিয়ে নিষ্পন্ন করা মানুষটা আর কেউ নয়, অতি বড় রাজাকার যেন জিয়াউর রহমান।
হুমায়ুন আজাদ যথার্থই রচনা করেছেন বাংলার কলঙ্কজনক অধ্যায়ের নির্মম উপহাস।
পদার্থ জায়গা দখল করে না কিন্তু শফিউল্লাহ- আরেক উচ্চবাচ্যহীন ঘাতক কাটা সেনা প্রধানের জায়গা দখল করেও অপদার্থ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেছিল; আক্রান্ত রাষ্ট্রপতির শেষ নির্দেশ সত্ত্বেও এক বস্ত্রে তিনদিন প্রেসিডেন্ট হাউজে কাটানো ছাড়া ন্যুনতম ভূমিকা পালন করার জন্য মেরুদন্ডকে সোজা দেখাতে পারে নাই, সেনাবাহিনীকে কলঙ্কলিপ্ত করার শুরু এখনেই।
সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে কতিপয় সেনা সদস্য স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যালীলা সাঙ্গ করা থেকে পরবর্তীকালে তাদের বেশুমার উচ্ছৃঙ্খলতাকে নমনীয়তা ও কমনীয়তা দিয়ে দেখা, মিঠেকড়া টুকটাক নির্দেশ- এলোপাথারিভাবে- হাস্যাস্পদীয় ক্রীড়াকৌতুক- চেতনায় আরেক মোনাফেকি।
বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি-চীফ করেছিলেন। সেনা প্রধানের ক্ষমতা ওসমানীর কাছ থেকে তার ওপর ন্যাস্ত করা হয়েছিল- ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া পরিস্থিতির জন্য ঘোড়ার পাশে গাড়ির সঙ্গে আরেকটি ডেপুটির আসন জুড়ে দিতে হয়েছিল; এসবের মধ্য দিয়ে এই শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান বানানো উর্দ্ধালোকে পতন (প্রমোশন) বলে প্রমাণ রাখতে নির্দ্ধিধায় সক্ষমতা দেখিয়েছে এই অভিনব মানুষ।
জাহিদ নেওয়াজ খান, এই গ্রন্থে বিষয়বস্তু গোয়েন্দা ও সেনাব্যর্থতার প্রতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যালীলা সাঙ্গ করার প্রেক্ষাপটে আলোকপাত করলেও আমরা এই গ্রন্থের অক্ষরমালায় ধ্বনিত হতে দেখি নানা প্রকার নীরবতা, উদাসীনতা, নিস্পৃহতা, ভয়-লাজ, দুরভিসন্ধিমূলক অবদান।
ব্যর্থতা ও নিম্নগামিতা সর্বব্যাপী ছিল না। সেনাগণ্ডির বাইরে আমরা দেখেছি চাষাভুষা মানুষের অব্যর্থ দায়িত্ব পালন।
বঙ্গবন্ধুর লাশবহনকারী সেনাদের তাড়াহুড়া- ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে দাফন কার্যে প্রবল বাঁধা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে লাশ গোসল, কাফন পরানো ও জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দেশনায়ককে সমাহিত করে নির্ভিক চিত্তের জয় দেখিয়ে দিয়েছিল ৭৫-এর ১৬ আগস্ট অপরাহ্ন শেষে নিরস্ত্র কিছু মানুষ সেনা সদস্যরা হুকুম দিয়েছিল লাশ যে অবস্থায় আছে সেভাবেই দাফন করতে। সেই সময়ে তা বড় বড় সেনা বাহিনীর উর্দ্ধেপতিত অফিসাররা যেভাবে কেঁচোর মত গর্তে লুকাচ্ছিল- তখন গ্রামের মানুষ লাশ দাফনে অজাচার রুখে দিয়ে মুসলমানের লাশ বিনা গোসলে বিনা জানাজায় দাফন করা বিরত থেকে সাধ্যমত যথাসম্মানে ধর্মের অনুশাসন মেনে লাশকে কবরে শেষ শয্যায় রেখে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ
শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘন ঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও;
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।
নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।
– ইলেক্ট্রার গান// শামসুর রাহমান
তথ্য-উপাত্তভিত্তিক অভিজ্ঞতা নির্ভর বিশ্লেষণমূলক তিনটি উপাদানের স্বরূপে প্রকাশ গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে মনের আয়নায় প্রতিফলিত হলো ৬/৭ বৎসর আগে একটি উপন্যাস লিখতে মনস্থির করলে, বঙ্গবন্ধুর উত্থান-পতন বন্ধুর জীবনের সত্য-তথ্য-উপাত্ত, আপ্ত বাক্য খোঁজার ঘর্মাক্ত দিনলিপি। বড় টানাপোড়েন হয়েছিল নানারঙে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে আখ্যান রচনা করতেÑ অভাব ছিল তুলি ও কলমের। চারিদিকে নানা প্রকার নীরবতা। গর্ভস্রাবের মতো অজস্র বই কিন্তু তা মহাকাব্যিক মানুষটির ট্রাজেডি ও এরর, ভিক্টরি ও জয়ফুল পেইন উন্মোচনের জন্য, নিজস্ব মনপ্রিয় শব্দ-বাক্য-ভাষা খুঁজে পেতে যথেষ্ট কষ্ট ছিল। তবু মহাকাব্যিক পুরুষটির কাহিনী আমাকে লিখতে হবে, আশংকা ছিল এই কাহিনী আগে যারা শুনেছে তারা অবিশ্বাস করবে, যারা ভবিষ্যতে শুনবে অবিশ্বাস্য বলে রায় দেবে তারাও। রচনা লিখবার জন্য কলম হাতে তুলে নেবার পর কখনো গতিহীন, কখনো উদ্যাম, তবু বোধ অবোধ হয়ে উঠছিল যেনবা আমি হেটে চলেছি কার্ণিশ দিয়ে,- একটু পা হড়কালে নেতার দ্বিতীয় মৃত্যু আমার হাতে ঘটবে এবং রক্ত ডোবানো কলম হাতে খুনির মতো নিজের জন্য নিজের ফাঁদ পাতব।
শেষ পর্যন্ত উপন্যাস প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। লিটিল ম্যাগাজিন ভার্সনে শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে” প্রকাশ পায় এবং অনতিবিলম্বে ইতি তোমার মুজিব” গ্রন্থাকারে শেখ মুজিবের কথা বলে।
প্রসঙ্গের অবতারণা এই জন্য যে, আজকের আলোচিত বইটার মতো কোন নির্ভরযোগ্য টেক্সট হাতে পেলে আমার শ্রম সাধ্য প্রয়াস নিমেষে অনায়াস হত। এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনেক দরকার মেটাবে আমাকে স্বতঃপ্রণোদিত হতে তাড়িত করে বইটি নিয়ে প্রমোশনাল- যা শুনেই আমার অনুজ প্রতিম কবি ও প্রকাশক রবীন আহসানকে বিস্তারিত বলতেই আমার হাতে চলে আসে গ্রন্থটি। হতাশ করেন নাই সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান।
অস্বীকার করলে অন্যায় হবে যে, দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখা-পড়ার জীবনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকােত্তর সাংবাদিকতায় পাঠরত আমাকে অসামান্য আর একটি গ্রন্থ আমার সামনে উড়িয়ে দিয়েছিল লাল রুমাল।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কী প্রকার এবং লিখলে কী কী ঘটে তা বুঝে উঠবার জন্য উচ্চমার্গীয় যোজনা ছিল সেই গ্রন্থ- যা আমার জন্য উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে কথকতা রচনা করতে অশেষভাবে সূত্রধরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
জাহিদ নেওয়াজ খানের পূর্ব প্রজন্মের সাংবাদিক জনাব এ,এল, খতীব সাহেবের কলমে তৎকালীন সময়ের অজানা অনেক তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল; মুজিব হত্যা সংক্রান্ত অসামান, সেই দলিল ”Who killed Mujib” নামে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়।
জনাব খতীব মুজিব হত্যা থেকে পরবর্তী অনাচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং কলমের খোঁচায় জানাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকতায় দীক্ষিত ও শিক্ষিত অপরূপ তাকেই বলব, সেই জাহিদ নেওয়াজ মুজিব হত্যার একুশ বছর পর সেই নির্মম হত্যাকা-ের বিচার আরম্ভ হয়ে আরো ১৩ বৎসর অর্থাৎ মোট ৩৪ বৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিচারের রায় অনুযায়ী হত্যাকারীদের কতিপয়ের কেবল পাওনা শাস্তির পূরণ করতে।
আমি খিন্নবোধ করি, যে, রাষ্ট্রপিতার নির্মম হত্যার বিচারে প্রজন্মান্তর অতিবাহিত হয়ে গেছে।
এক প্রজন্মের সম্মুখে সংঘটিত হয়েছিল হত্যালীলা, আরেক প্রজন্মের প্রতিনিধির কর্মপরিসরে বিচারহীনতা সংস্কৃতি হতে আইনের শাসন মুক্তিলাভ করেছিল।
যতদিন, যতকাল, যতবার নামবে বৃষ্টি তখন মুজিবর বারবার।
নম নম বৃষ্টিতম মুজিবর নম।
রক্তধারা বৃষ্টিধারা হয়ে মাটিতে মিলায়। বৃষ্টির শ্লোগানে মুজিবর।
জাগ্রত শ্রাবণ। বৃষ্টি অবিরাম।
মুজিবর অনিঃশেষ। বৃষ্টিতে মাটির সোঁদা গন্ধে মুজিবর, মুজিবর।
মরা নদী বৃষ্টির ধারায় আবার জাগে…
[লেখকের শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে-উপন্যাসের (২০১৩) শেষ অক্ষরমালা]
সৌজন্যে বইনিউজ