ময়মনসিংহে আমাদের বাসার পাশেই পরাগদের বাসা, মহারাজা রোডে। ডা. কে জামান খালুর বড় ছেলে পরাগ। পরাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাকিল আর পরাগ আমার আশৈশব বন্ধু।
এভাবেই শাকিলের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। পরাগদের বাসার আড্ডায় অনেক বেশি সময় পেয়েছি শাকিলকে। ওরা ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ছাত্র, আমি মৃত্যুুঞ্জয় স্কুলের। ছোটবেলায় লেখালেখি, সংগঠন করার কারণে শাকিল আমাকে ‘কবি’ বলে সম্বোধন করতো! ওর দরাজ গলায় ‘কবি’ সম্বোধন শুনতে খারাপ লাগতো না।
শাকিলকে সফেদ পাঞ্জাবীতে খুব মানাতো। একদিন বলেছিলাম, তোমার হ্যাঙ্গারটা দারুণ, যা পরো তাতেই ফিট। ‘হ্যাঙ্গার’ শব্দের অদ্ভুত ব্যবহারে ও খুব মজা পেয়েছিল। বলেছিল, তোর হ্যাঙ্গারটা কিন্তু পুইট্টা (খাটো)! বলেছিলাম, জেনেটিক।
খোকা চাচা, শাকিলের বাবা। উনার সাথে সামাজিক সংগঠন করতে গিয়ে বেশ খাতির হয় আমার। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এককথায়, অসম্ভব ভদ্রলোক তিনি। ১৯৯৫ সালে চাকুরিসূত্রে ময়মনসিংহ ছেড়ে দেওয়ায় এই শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মানুষদের থেকে খুব দূরে চলে এসেছি। আর শাকিলতো চলে গেল সবকিছুর ওপারে!
আমি কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতায় যুক্ত হয়ে পড়ি। তখন পরাগ, শাকিল সবাই একাথে ছাত্র ইউনিয়ন করি। শহরের স্টেশন সংলগ্ন মালগুদামে ছাত্রনেতা বারীন্দ্র ঘোষ কাজলের কাছে বাঁশের কঞ্চিতে রং লাগিয়ে দিয়ে পোস্টার লেখা শেখা! কী নিষ্পাপ সময় আমাদের।
পরে, শাকিল ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয় কিন্তু আমৃত্যু আমাদের বন্ধুত্বে রাজনৈতিক বিষয়টি কোন বিশেষ ঘটনা হয়ে ওঠেনি! পরাগও ছাত্র ইউনিয়ন করতো। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটি সকল কিছুর চাইতে আলাদা ছিল।
ঢাকা বা ময়মনসিংহ কোথাও দেখা হলেই সহাস্য মুখে শাকিল বলতো ‘কবি, ফোনটোন তো দেস না’। আমি ইয়ার্কি করে বলতাম, ক্ষমতাসীনদের আমি ভয় পাই! শাকিল হো হো করে বলতো, ‘বিটলামি করছ? তোর সাথে আমার ক্ষমতা কী রে?’
সত্যিই, আমি শাকিলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মজীবনে কম যোগাযোগ রেখেছি। তারও ব্যস্ত জীবন, আমারও অযথা বিরক্ত করার কম ইচ্ছা। যখন ওকে প্রয়োজন হয়েছিল তখন সে মরেই গেল! আমার প্রয়োজনের পুরো ধকলটা সহ্য করেছে খোকন। দৈনিক মুক্তকন্ঠে আমার সহকর্মী, প্রিয় আশরাফুল আলম খোকন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে সদস্যপদে নির্বাচন করি ২০১০ সালে। ওমর ফারুক-শাবান মাহমুদ প্যানেলে। শাকিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভোটারদের ভোট চেয়ে লিখলো, ‘পলাশ চৌধুরীর জয় হোক’ আমিতো অবাক!
এমনি এক শীতের ভোররাতে শাকিলের ফোন, অসময়ে আমার ফোন ধরা নিয়ে দুষ্টামি শেষে শিশুর মতো একটা আবদার করলো! আমিও কখনো কখনো শিশু হয়ে যাওয়া বন্ধুর পুরো আবদারটি দায়িত্ব নিয়ে মিটিয়ে দিলাম, বিনিময়ে আড্ডা দিলাম, ক্লোজডোর। এমন বন্ধু হঠাৎ হারিয়ে গেলে সত্যিই কষ্ট হয়!
৬ ডিসেম্বর ২০১৬। ফেসবুকে সহকর্মী-বন্ধু ফারজানা রূপার লেখা, ‘কি শাকিল ভাই’ এরকম একটি লেখা দেখে থমকে গেলাম, মনটা মোচড়াতে লাগলো। ফেসবুক হাতরাতে লাগলাম, আমি কি শাকিলের মৃত্যু সংবাদটিই খুঁজছিলাম? কিছুক্ষণের মধ্যেই পেলাম মৃত্যু সংবাদ! ফেসবুক নিউজ ফিডে, টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল আমাদের মাহবুবুল হক শাকিল।