রোববার রাত দশটা। লাস ভেগাসের ম্যানডালে বে ক্যাসিনোর কাছের খোলা মঞ্চে রুট নাইনটি ওয়ান হারভেস্ট কনসার্ট হচ্ছিলো। গান গাইতে গায়ক জেসন আলডিন যখন মঞ্চে এলেন, তখনই উপর থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। হঠাৎ গুলির শব্দে থেমে গেল গানের ছন্দ। মঞ্চের সামনে থাকা হাজার হাজার দর্শকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।
‘এলোপাথারি গুলি লেগে চোখের সামনে লোকজন মাটিয়ে লুটিয়ে পড়তে থাকলো। মনে হচ্ছিলো যেন আমারও গুলি লেগেছে, মরে যাচ্ছি। সবাই তাদের বন্ধুদের রক্ষা করার চেষ্টা করছিলো। গুলি লেগে মানুষ পাখির মতো মাটিতে পড়ছিলো।’
এভাবেই রোববার রাতের লাস ভেগাসের ভয়াবহ বন্দুক হামলার বর্ণনা দিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর আবার গুলির শব্দ শুরু হয়, সেই সঙ্গে শুরু হয় আতঙ্কিত মানুষের ছুটোছুটি আর চিৎকার। তখন বোঝা যায় গুলি আসছিলো ম্যানডালে বে হোটেলের উপর থেকে।
ভয়াবহ আতঙ্কের এই গুলি চলে প্রায় দশ মিনিট ধরে। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক । এই সংখ্যা বাড়ছে। ঘটনার পর পুলিশ লাস ভেগাস বুলেভার্ডের একটি অংশ বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ওই এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক ইতিহাসে এত বড় সন্ত্রাসী হামলা এর আগে কখনো ঘটেনি। এর আগে ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডের একটি নাইট ক্লাবে সন্ত্রাসী হামলায় ৪৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তার আগে ২০০৭ সালে ভার্জিনিয়ার টেকে ৩২জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করে বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেছিল।
জেসন আলডিন ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে লিখেছেন, আজ রাতে যা ঘটল তা ভয়ঙ্কর বললেও কম হয়। কি বলব, আমি বুঝতে পারছি না এখনও। আমি আর আমার দলের সবাই বেঁচে আছি। হতাহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের আনন্দের একটা রাত কাটানোর কথা ছিল, সেজন্যই তারা এসেছিলেন, কিন্তু যা ঘটল, তাতে আমার বুক ভেঙ্গে গেছে।
এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গড ব্লেস ইউ লিখে টুইট করেছেন।
লাস ভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তার ২২ বছর বয়সী মেয়ে উপস্থিত ছিলেন ওই কনসার্টে। বিল ইয়াং ঘটনা বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমার মেয়ে যখন আমাকে ফোন দেয় তখন তিনি মেশিন গানের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। ও আর ওর বন্ধুরা মিলে একটি টেবিলের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল।
আমি যখন আমার ফোন ধরি, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, ‘বাবা, বাবা, বাবা, বাবা, বলে চিৎকার ভেসে আসছিলো। ও বলছিলো, বাবা, আমাদেরকে কে যেন গুলি করছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি তাকে ঠান্ডা হতে বলি এবং যত দ্রুত সম্ভব দৌড় দিয়ে স্থান থেকে দূরে সরে আসতে বলি। তারপর প্রাণপণে ছুটে আসি এখানে।’
ইতোমধ্যে হামলাকারীর পরিচয় ও তার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। ৬৪ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা স্টিফেন প্যাডোক ম্যানডালে বে হোটেলের ৩২ তলায় তার ভাড়া নেয়া রুম থেকে নিচে থাকা ২২ হাজারের বেশি কনসার্ট দর্শকদের উপরে গুলি চালায়। ঘটনার পর পর লাস ভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশের শেরিফ জোসেফ লম্বার্ডো প্রথমে জানিয়েছিলেন, ওই ক্যাসিনোর ৩২ তলায় সন্দেহভাজন হামলাকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পরে অবশ্য পুলিশ জানান যে, স্টিফেন প্যাডোক নামের ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন।
প্যাডোক ঠিক কী কারণে এই হামলা চালিয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি পুলিশ।এমনকি তার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কেও পুলিশ সন্দিহান। তবে তিনি বিকারগ্রস্ত ছিলেন বলে ধারণা করছে পুলিশ জানিয়েছে।
প্যাডোকের রুমে গিয়ে পুলিশ অন্য কোন বন্দুকধারীকে দেখতে পায়নি। তবে তার রুমে দশটির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পুলিশ প্যাডোকের ৬২ বছর বয়সী বান্ধবি মারিলু ডেনলি এবং দুটি গাড়ির সন্ধান করছে। তবে সে এই ঘটনার সঙ্গে বান্ধবির সম্পৃক্ততা ছিল কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তারা। সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে ওই রুমটি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই হামলায় ৫৮জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।
কে এই প্যাডোক?
৬৪ বছর বয়সী প্যাডোক লাস ভেগাস থেকে ৮০ মাইল উত্তর-পূর্বের নেভাদা অঞ্চলের মেসকুইটের বাসিন্দা। স্থানীয় নিরাপত্তা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা তাকে চিনতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি লাইসেন্সধারী পাইলট ছিলেন। দুটি প্লেনের মালিকও তিনি। আলাস্কায় শিকার করার লাইসেন্সও ছিল তার।
কি বলছে প্যাডোকের পরিবার?
সোমবার প্যাডোকের ভাই ইরিক হাডসন প্যাডোক লাস ভেগাসের হামলার ঘটনায় তার ভাই জড়িত শুনে আকাশ থেকে পড়েন। তিনি ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের এই সম্পর্কে ন্যূনতম কোন ধারণা নেই যে তিনি (স্টিফেন) কেন এই হামলা চালালেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এই ঘটনায় পুরোপুরি হতভম্ব। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।’
জানা গেছে, স্টিফেন প্রায় শতাধিক রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। তাকে থামাতে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশও জবাবে পাল্টা গুলি চালায়।
ঘটনার পর লাস ভেগাসের অনেক হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও লাস ভেগাস ম্যাককারান বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক বিমান অবতরণ করার আগেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক ফ্লাইটও বাতিল করা হয়েছে।