ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জীবনে হজ পালন মানে অনেক বড় একটা স্বপ্নপূরণ। এ স্বপ্ন পালনের জন্য বছরের পর বছর কেউ কেউ অপেক্ষা করেন, যারা সীমিত আয়ের মানুষ, তারা একটু একটু করে টাকা সঞ্চয় করতে থাকেন ওই স্বপ্নপূরণের জন্য। অনেকে আবার বাড়তি ভিটেমাটি বিক্রি করেও হজ পালনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, জগত সংসারের যাবতীয় পাপকর্মের জন্য তওবা করে কঠোর সংযম আর ত্যাগের মাধ্যমে নিয়মকানুন পালন করে হাজী হয়ে সৌদি থেকে দেশে ফিরবেন। তারপর বাকি জীবন আল্লাহর পথনির্দেশ মতে জীবনযাপন করবেন।
কিন্তু সেই মহৎ উদ্দেশ্যের পথে যদি বাধা আসে? ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসে যখন জানতে পারেন তাদের ভিসা প্রসেসিং এখনও ঠিক হয়নি, মোয়াল্লেম ফি নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা, তখন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অবস্থা কি হতে পারে?
প্রতিবছর এই ধরনের ঘটনা ঘটলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় না পরের বছরের হজ প্রস্তুতির আগে। যার ফলে ফিবছরই হজযাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। ঢাকায় এসে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কারণ তারা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে যখন আসেন তখন তারা এই জগত সংসারের সব কিছু ভুলে, অর্থ সম্পদের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় ঘর থেকে পা ফেলেন। সে এক অন্যরকম অনুভূতি! খাঁটি মুমিন মুসলমানমাত্রই সেই অনুভূতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন মাত্র। কিছু অর্থলোভী মানুষের কারণে তাদেরকে পদে পদে দুর্ভোগে পড়তে হয়। যাদের আত্মীয়স্বজন ঢাকায় আছেন তাদের কথা ভিন্ন। আর যাদের নেই তাদের দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয়। একবার হজক্যাম্প একবার হোটেলে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকতে হয়।
কেন এই পবিত্র কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবার পর তাদেরকে অসহায়ের মত দিন পার করতে হয়। এর জন্য কারা আসলে দায়ী? আমরা পত্রিকা আর টেলিভিশন মারফত জানতে পারি ভিসা জটিলতা আর মোয়াল্লিম ফি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে যাত্রী সংকটে হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর জন্য ক্ষুব্ধ যাত্রীদেরকে টেলিভিশনে কাঁদতেও দেখা যায়। কি অসহায় সেই মুখ তাদের! এমনও হয়েছে, এক সাথে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন বারোজন। চারজনের কোনো সমস্যা হয়নি। বাকি আটজনের ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে একসাথে যাওয়া হয়নি। অনেক স্বামী-স্ত্রী একসাথে হজে যাবার নিয়ত করেন। কিন্তু দেখা গেছে, স্বামীর ভিসা হয়েছে কিন্তু স্ত্রীর ভিসা না হবার কারণে দুজনের কারো যাওয়া হয়নি।
এ বছরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। চলতি বছরে এক লাখ সাতাশ হাজার জন হজে যাবেন বলে মন স্থির করেছেন। গত ২৪ জুলাই থেকে হজ ফ্লাইটের যাত্রা শুরু হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী পরিবহন করছে। কিন্তু ভিসা ও মোয়াল্লিম ফি জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে অনেক যাত্রীরা সৌদি আরবে যেতে পারেননি। বিষয়টি বিমানমন্ত্রীও ওয়াকিবহাল। তিনি বলেছেন, যাদের ভিসা হয়নি তারা যেন দ্রুত ভিসা করেন সেজন্য খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে মুঠোফোনে। কিন্তু এটাই কি সমাধানের একমাত্র পথ?
এ বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ভিসাসংক্রান্ত জটিলতার জন্য হজ এজেন্সিগুলোকে দায়ী করেছেন। দায়ী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেছেন, লাইসেন্স বাতিল, জরিমানাসহ আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ক্ষমা করা হবে না।
আমরা খুবই আশাবাদি হই ধর্মমন্ত্রীর এই কঠোর হস্তক্ষেপ দেখে। যাক তা হলে আগামি বছর থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আর ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায় পড়তে হবে না। কিন্তু এই হজ নিয়ে আরেকটি ঘটনা যখন পত্রিকা মারফত আমরা পড়ি তখন বিশ্বাসই করা যায় না যে এ রকম ঘটনাও ঘটতে পারে! সেটি হল সৌদি আরবে অবস্থানকালে হজযাত্রীদের চিকিৎসকদের সহায়তা করতে এ বছর ১৭১জনের তালিকা করা হয়েছে।
নিয়ম হল এ সহায়ক দলে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেবক এবং অফিস সহকারীদের যাওয়ার কথা। তাদের কাজ হচ্ছে অসুস্থ হাজীদের সেবা করা, ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করাসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করা। কিন্তু অভিযোগ আছে যাদের নেওয়া হয় তাদের অনেকেই এসব কাজ করে না। এ বছর যাচ্ছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও সংস্থার ২৫ জন গাড়িচালক। রয়েছেন নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক, পাম্প অপারেটর, টাইপিষ্টসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষিবিদ ও ফার্মাসিস্টও যাচ্ছেন দলের সদস্য হয়ে।
যে মন্ত্রী হাজিদের ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার এলাকার লোকদের হাজিদের সহায়ক দলে বেশি নিয়েছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য তিনি বলেছেন, আমাদের কাছে ময়মনসিংহের যারা আবেদন করেছেন তাদের নিয়ে যাচ্ছি। গাড়িচালকদের কেন নেওয়া হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে বলেছেন, অনেক দপ্তর অনুরোধ করেছে, এ ছাড়া অনেকে পরিচিত, তাই তাদের নেওয়া হচ্ছে।
এই হচ্ছে আমাদের নীতিবোধ। হজের মত একটি পবিত্র বিষয়কে কিভাবে কলুষিত করা যায় তা নিয়ে শুধু হজ এজেন্সি নয় নীতি নির্ধারক পর্যায়ের মানুষের অনিয়ম আমাদের বিস্মিত করে। হজ যেন একটা উপলক্ষ্য মাত্র, এর পেছনে রয়েছে ব্যবসা, মুনাফা আর স্বজনপ্রীতি। আমাদের ভেতরে জেগে উঠুক সেই চেতনাবোধ, যে বোধের কারণে মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ স্থান পাবে সবকিছুর উর্ধ্বে। থাকবে না অতি মুনাফাখোরি চিন্তা আর ক্ষমতার কারণে স্বেচ্ছাচারি মনোভাব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)