কক্সবাজারে গত দু’দিন আগে হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ৫ সন্তানকে হারিয়েছেন এক মা। অবিশ্বাস্য এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা কি কেবলই দুর্ঘটনা বলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি? এসব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হাসিনাপাড়া গ্রামের মানু রানী পাঁচ সন্তানকে হারিয়ে এখন শোকে স্তব্ধ। কয়েক দিন আগে তার স্বামী মারা যান। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের তারিখ ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। আগের দিন মন্দিরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে ফেরার জন্য সড়কের পাশে অপেক্ষা করছিলেন আট ভাই। এরই মধ্যে একটি পিকআপ ভ্যান তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলে চার ভাই ও পরে হাসপাতালে আরেক ভাই মারা যান। এই দুর্ঘটনা কেবল মায়ের কোল থেকে চার সন্তানকে কেড়ে নেয়নি, চারজনের স্ত্রীরা বিধবা ও সন্তানেরা এতিম হয়ে গেল।
একইভাবে চট্টগ্রাম-ফটিকছড়ি সড়কে টহল চৌকিতে পুলিশ একটি ধানবোঝাই চাঁদের গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করলে চালক দ্রুত চালিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। সেসময় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দুই স্কুলছাত্রী। একপর্যায়ে চাঁদের গাড়ি তাদের চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে গিয়ে এভাবে প্রাণ হারাল দুই শিক্ষার্থী। এসব মৃত্যুকে কোনোভাবে নিছক সড়ক দুর্ঘটনা বলে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। প্রথম ঘটনায় এককভাবে চালক দায়ী। দ্বিতীয় ঘটনায় চালকের সঙ্গে পুলিশের যুক্ত থাকার গুরুতর অভিযোগ আছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী: ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। সড়কে আমাদের আর কত মৃত্যুর মিছিল দেখতে হবে। আগে দুই যানবাহনের সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটত। এখন সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকেও পিষে মারা হচ্ছে। অথচ কোনো প্রতিকার নেই।
সড়কের নিরাপত্তার জন্য ২০১৮ সালে যে আইন করেছিল সরকার, তা-ও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না একশ্রেণির মালিক ও শ্রমিকের বিরোধিতার কারণে। প্রকৃত প্রস্তাবে সড়কে সরকার তথা বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে স্বার্থান্বেষী মহল, যার মধ্যে একশ্রেণির মালিক ও শ্রমিকনেতাও আছেন। এই লেখা পর্যন্ত সাতকানিয়া ও ফটিকছড়িতে যে চালকেরা গাড়িচাপা দিয়ে সাতজন মানুষকে হত্যা করেছেন, তারা এখনও ধরা পড়েননি। তাহলে বিচার কীভাবে হবে? প্রতিদিনই সড়কে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে, অথচ যাদের দেখার কথা, তারা নির্বিকার। সড়ক ও সেতু বিভাগের মন্ত্রী রাজনীতি নিয়ে অহরহ কথা বললেও সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কোন কথা বলেন না।
এভাবে কোনো দেশের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা চলতে পারে না। সড়কে চলমান নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতেই হবে। সরকারের নীতিমালা তৈরি হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। এটা একটা তামাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোনো রাষ্ট্র তার নীতিমালা বাস্তবায়ন না করে দেশ চালাতে পারে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশটি কোনো অলৌকিক ইশারায় চলছে। এখানে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কোনোটাই নেই। আছে কেবল সন্তান হারানো পিতা হারানো ভাই হারানো কন্যা হারানো স্বামী হারানো হাহাকার। ৫৫ হাজার বর্গমাইলব্যাপী কেবল শোক আর বিচারহীনতার বিস্ময়কর নিরবতা। আমরা মনে করি বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়। এগুলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।