সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান এবং দুর্ঘটনার ঘটনার তদন্তে হত্যা প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের সাজার বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’-র খসড়া প্রস্তাবনায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সোমবার সকালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়া প্রস্তাবনা তোলা হলে তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। আইনটি সংসদে উত্থাপনের পরে পাস হলে কার্যকর হবে।
বর্তমানে প্রচলিত আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হয় ৩০৪(খ) ধারায়। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছরের কারাদণ্ড। যা নিয়ে ক্ষোভ ছিল জনমনে, আবার নতুন আইন প্রণয়ন না করতে পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের সরাসরি চাপ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে সাজা কিছুটা বেড়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সতর্কতা বিষয়ে আগেপিছের চিন্তা থাকে না বলে অনেকে অভিযোগ করে থাকেন। কাজেই সাজা যতই বাড়ানো হোক না কেন, তা অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন ঘটাবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে। সদ্য অনুমোদিত আইনে এ বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
নতুন আইনে যোগ করা হয়েছে লাইসেন্স পাবার বয়সভিত্তিক যোগ্যতা ও নূন্যতম শিক্ষাগত যোগত্যার সীমারেখা। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য ন্যূনতম বয়স ধরা হয়েছে ১৮ বছর। আর পেশাদার লাইসেন্স পেতে হলে বয়স হতে হবে ২১ বছর। অন্যদিকে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে আবেদনকারীকে। এটি আগের আইনে ছিল না।
সড়কে ছোটখাট দুর্ঘটনা হলে বা পরিবহন শ্রমিক আটক হলে কিছুদিন পর জামিনে বা সাজাভোগের পরে বের হয়ে আবার রাস্তায় নেমে যেতেন। নতুন আইনে চালককের জন্য পয়েন্ট বরাদ্দ বা কর্তনের বিধান রাখা হয়েছে। প্রত্যেক চালকের লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে। চালকের ভুলের কারণে পয়েন্ট কাটা যাবে। ট্রাফিক সিগন্যালের লালবাতি অমান্য করে মোটরযান চালনা করা, পথচারি পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট স্থানের কাছে বা ওভারটেকিং নিষিদ্ধ, এমন জায়গায় ওভারটেক করা, এমন বিভিন্ন অপরাধের একেকটির জন্য একটি করে পয়েন্ট কাটা যাবে। এভাবে চালকের পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে আর কোনোদিন ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। এটি একটি বহুল প্রচলিত আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। এবার নতুন করে এই পদ্ধতি বাংলাদেশের আইনে যুক্ত করা হচ্ছে।
এছাড়া পরিবহন শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে দেয়া হবে, যা সবাইকে মানতে বাধ্য করা হবে। মাদক বিষয়েও থাকছে কঠোর নিয়ম, মাদক সংশ্লিষ্টতায় চালকের লাইসেন্স বাতিল/স্থগিতের বিধান করা হয়েছে। সড়কে জনস্বার্থে অতিরিক্ত হর্ন বাজানো বন্ধে থাকছে শব্দমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। দুর্ঘটনায় হতাহত যাত্রী-সাধারণের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রেখে বিশেষ তহবিল গঠনের নির্দেশনা থাকছে আইনে। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ একটি চিন্তাশীল ও কার্যকর আইন হতে যাচ্ছে।
আইনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা যাই থাকুক না কেন, অতীত অভিজ্ঞতা অনুসারে সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া এবং আইনের বিভিন্ন ধারার অপপ্রয়োগ একটি কর্কটময় সমস্যা। আইন থাকে, বিধান থাকে কিন্তু তা যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় সমস্যা সমস্যাই রয়ে যায়। বিষয়টি আমাদের আবারও ভাবাচ্ছে। আমাদের আশাবাদ, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিয়ে মহামারীর মতো সারাবছর ঘটে যাওয়া সড়কসন্ত্রাস থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে কাজ করে যাবেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ।